Sisamarar Dhare Aamader Bari

শিশামারার ধারে আমাদের বাড়ি

শান্তনু মাইতি

শিশামারা একটি নদীর নাম।

আমাদের হাসপাতালের চোখের ডাক্তারবাবু কৃষ্ণেন্দুদা এক আড্ডায় বললেন, তোমরা শিশামারা গেছো? যদি না গিয়ে থাক, এই শনিবারই চলে যাও, এক রাত থেকে এসো, দেখবে নদী আর জঙ্গলের রূপ। তখনও পর্যন্ত নামটাই জানতাম না। এক শনিবার দুপুরে ডিউটি শেষ করে শিশামারার উদ্দেশে পাড়ি দিলাম। কোচবিহার থেকে পুন্ডিবাড়ি হয়ে সোনাপুর মোড় থেকে ফালাকাটার রাস্তায় খানিক এগোলেই শিলতোর্ষা ব্রিজ। পেরিয়ে ডান দিকের রাস্তা ধরে গ্রামের বাড়িঘর শাকসব্জিভরা খেতখামার দেখতে দেখতে এক ঘন্টায় পৌঁছে গেলাম, শীতের বিকেলের শিশামারা।

উঠেছিলাম রাইনো কটেজে। তখনও এখনকার মত পাশাপাশি অনেকগুলো লজ বা হোমস্টে ছিল না। টুরিস্টদের ভিড় ছিল না। অরণ্যের সৌন্দর্য ছিল আদি অকৃত্রিম অনন্য। বারান্দা থেকে সামনের নীল জলের শিশামারা নদী আর ওপারের সবুজ জলদাপাড়া দেখে মন ভরে যায়।  এমন নদীর প্রেমে পড়লে ছুটে যেতে ইচ্ছে হয় বাবার। ফলে প্রায় প্রতি শীতেই চলে যেতাম শিশামারার তীরে। লজের ম্যানেজার রণবীর, স্থানীয় যুবক, তাদেরই বিক্রি করা জমিতে লজ। তার সঙ্গে গল্প জমে ওঠে, জঙ্গলের গল্প। স্থানীয় সংবাদ সংগ্রহ করি। জঙ্গলের জীবন বাঘ হাতির সঙ্গে লড়াই করার জীবন, কঠোর সংগ্রামের জীবন।

বছর পঞ্চাশ আগে রণবীরের বাবা কাকারা বাংলাদেশ ছেড়ে চলে আসে, ঠাঁই হয় এই জঙ্গলের ধারে, মাচার উপর ছিল সবার ঘর, হাতির ভয়ে। পাশেই ছিল এই নদী, ফি বছরের বন্যা ছিল নিয়মমাফিক। নদীর মাছ, জঙ্গলের হরিণ শুয়োর মোরগ ছিল অনেক, খাবারের অভাব ছিল না। সংরক্ষণ শব্দটা এ তল্লাটে তখনো কেউ শোনেনি। জঙ্গল সাফ করা কিছু জমিতে ধান শাকসব্জি হত। রণবীর যখন বেশ ছোট, একরাতে হাতি এসে বাড়ির ধানের গোলায় হানা দেয়। তাড়াতে গিয়ে বিশাল এক দাঁতালের আক্রমণে তার বাবার প্রাণ যায়। জঙ্গলের ধারে বসতিতে এ যেন এক পরিচিত স্বাভাবিক গল্প।

এখান থেকে জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যানের শালকুমার গেট মাত্র দশ মিনিট। এক ভোরে উঠে চলে গেলাম সাফারিতে। কপালের জোরে এক বেলাতেই পেলাম দুটো গণ্ডার, একটা দাঁতাল হাতি, একদল গাউর। এই গেটের পাশেই ছেত্রীদার হোম স্টে। আরেক দিন বন্ধুদের জলদাপাড়া দেখাতে গিয়ে রাত কাটালাম তার বাড়িতে। তার সঙ্গে গল্প জুড়লে জঙ্গলের অনেক অভিজ্ঞতা স্মৃতিতে জুড়বে। ছেত্রীদা কোচবিহার কলেজের স্নাতক, বাইক চেপে প্রতিদিন কোচবিহার থেকে ফিরেছেন এই জঙ্গলে, কখনো অনেক রাতে, হাতি বাইসন লেপার্ডকে পাশ কাটিয়ে।

বছর দুই পর, রণবীরের থেকে ফোন এল, স্যার, আমি নিজেই একটা বাড়ি বানিয়েছি, একদিন সময় করে চলে আসুন। তারপর বছরে একবার অন্তত শীতে আসাই হয় শিশামারার তীরে, জঙ্গলের বিশ্রামে, রণবীরের বাড়ি। সকালে নদীর পাড়ে চেয়ার পেতে বসি, চা পকোড়া আসে। নদীর উপর অনেক পানকৌড়ি, ওপারে জঙ্গলের গাছের ডালে ডালে গ্রিন পিজন, সাঁই সাঁই শব্দে উড়ে যায় হর্নবিল, নীচে পেখম তোলা ময়ূরের নাচ।

সেখানে আলাপ হল পীযুষ বিশ্বাসের সাথে, রসণবীরের খুড়তুতো দাদা। ছোষবেলা থেকেই যার জঙ্গলে যাওয়া আসা। তার কাছে জঙ্গলের আশ্চর্য সব গল্প শুনে চমকিত হই।

নদী পার করে ওপারে যাও?

অনেকবার দাদা, আগে তো এই বাঁধ ছিল না, তখন নদীর চেহারা চরিত্র অন্যরকম ছিল। বর্ষাকালে সমুদ্রের মত, আমাদের মাচার ঘরের নীচে জল আর সাপ, উপরে মানুষ। শীতে আর গরমে নদীর হাঁটু জল। জঙ্গলে যেতাম জ্বালানি কাঠের জন্য। তখন ফরেস্টবাবুদের কড়াকড়ি ছিল না। নদীতে যেমন খুশি মাছ ধরতাম। কোনোমতে বেঁচে থাকা। বছর পনের আগে বন্যার পর নদী লাগোয়া চার গ্রামের মানুষ প্রশাসনের কাছে দরবার করি। দেবপ্রসাদ রায়, তখনকার এমএলএ উদ্যোগ নিয়ে ফান্ড জোগাড় করে বাঁধ তৈরির ব্যবস্থা করেন। তারপর থেকে আর বন্যা নেই, বেঁচে গেছি। আর এই যে এত লজ, মানুষের আনাগোনা, বাঁধ না হলে তো কিছুই হত না।

গন্ডারের মুখোমুখি হয়েছ কোনওদিন?

কতবার তা গুনে শেষ করা যাবে না। অনেকবার গুতো খেয়ে মরতে মরতে বেঁচেছি। প্রায়ই নদী পেরিয়ে গ্রামে ঢুকে পড়ত। একবার এক মা গন্ডার বাচ্চা নিয়ে আমাদের গোয়ালে গরুর সঙ্গে ছিল, বিট বাবু তিন দিনের চেষ্টার পর বনে ফেরাতে পেরেছে।

বাঘ আর অজগর সাপের লড়াইয়ের গল্প শুনবেন নাকি?

বাঘ আছে নাকি জলদাপাড়ায়?

নেই মানে? অনেক আছে। ওই বড় সাইজের বাঘটা নেই, কিন্তু যেটাকে বলে চিতাবাঘ, তার গায়ে তো প্রচুর জোর।  একদম আমার বাড়ির সোজা, নদীর ওপারে একটা ঝোরা আছে। ওই ঝোরাতে আমরা মাছ ধরতে যেতাম। একদিন গিয়ে হঠাৎ শুনি ভয়ঙ্কর ফোঁস ফোঁস শব্দ, দেখি একটা বিশাল বাঘ আর ইয়া মোটা লম্বা অজগর। ভয়ানক লড়াই। ভাবলাম, বাঘটাই মরবে, কারণ সাপটা যা লম্বা। কিন্তু না, উল্টো হল, আধঘন্টার যুদ্ধের পর দেখি অজগর নেতিয়ে পড়ল, আর বাঘ সেটাকে টেনে বনে নিয়ে চলে গেল।

তোমার হাত আর কনুইয়ে এত বড় দাগ কীসের?

আর বলেন না। একবার বুনো শুয়োরের বাচ্চা ধরতে গেছিলাম, হঠাৎ কোত্থেকে এক বরা এসে দাঁত দিয়ে চিরে দিল। পেটে বুকে লাগলে তো মরেই যেতাম। কোচবিহার হাসপাতালে সাত দিন ভর্তি ছিলাম।

দাদা, একদিন আসেন বাড়িতে, একটা পোষা ময়ূর আছে, দেখে যাবেন।

ময়ূর পোষা তো সরকারি নিয়মের বাইরে, ঘরে রাখলে কী করে?

ওই কথা তো বিটবাবুও বলে। ছোট একটা বাচ্চা ময়ূর অনেকদিন আগে উড়ে এসেছিল মায়ের সঙ্গে। আমাদের মোরগ-মুরগির সঙ্গে বাচ্চাটা থেকে যায়, বড় হয়েও আর যায়নি। বিটবাবুকে বললাম, আইন মেনে একে নিয়ে যেতে চাইলে নিয়ে যান, কিন্ত ও তো জঙ্গলের পরিবেশে বাঁচতে পারবে না। মনে হল ওরা ব্যাপারটা বুঝলেন, বললেন, তবে এখানেই থাক।

জঙ্গলের এমন সব রোমাঞ্চকর গল্প শুনতে শুনতে মনে মনে আমরাও যেন জঙ্গলের মানুষ হয়ে গেলাম। মনে হল কাজের অবসরে সপ্তাহের একটা দুটো দিন যদি এখানেই কাটাতে পারতাম। রণবীর বলল, আপনারা এত জঙ্গলে ঘোরেন, জঙ্গল ভালোবাসেন, তাহলে এখানেই একটা বাড়ি বানিয়ে ফেলুন, এই দাদার নিজস্ব জমি আছে নদীর ধারে, সরকারি দলিল রেকর্ড সহ, কিনে নিন অল্প জমি, একটা ঘর তৈরি করুন, থেকে যান নদীর ধারে। শেষে একদিন সেই শিশামারার ফাঁদে পা দিয়ে নিয়ে নিলাম একফালি জমি। কর্তা-গিন্নির পরিকল্পনা ও পরিশ্রমের গাছে একদিন ফল ফলল। আমাদের এই নতুন সন্তানের প্রতি ভালোবাসা যে একটু বেশিই তা তো নিশ্চয়ই টের পাচ্ছেন। সারা ভারতের প্রায় সব জঙ্গলের স্বাদ পাওয়া এই মন এখন শুধুই জঙ্গল-জঙ্গল করে। তাই মনে হয় জীবনের কিছুদিন অন্তত কাটুক এই জলদাপাড়ার জঙ্গলের গায়ে, শিশামারার ধারে।

আপনারাও চাইলে আসতে পারেন শিশামারার ধারে ছুটি কাটাতে। চাইলে আমার গিন্নির অতিথি (কাকলি মাইতি ৭০৭৬০৩৯৪৬৬) হতে পারেন, ঘরোয়া রান্নার স্বাদ নিতে পারেন। নীচের তলায় ড্রয়িং রুমে রয়েছে বেড়ানোর বইপত্রের সংগ্রহ। তবে হ্যাঁ, যাদের নিরিবিলি অপার শান্তি ভাল লাগে, জঙ্গল বাঁচিয়ে রাখবার দায়িত্ব পালনে যারা বিশ্বাসী কেবল তাঁরাই আসুন শিশামারার রূপ দেখতে। সবান্ধবে সপরিবারে যারা উদ্দাম ফুর্তি করতে চান তাঁদের জন্য শিশামারা নয়, গ্রামের শান্ত পবিত্র পরিবেশ বিঘ্নিত করা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

ছবি: সাত্যকি বিশ্বাস

সাম্প্রতিক সংযোজিত প্রতিবেদন

দ্রষ্টব্যঃ এই ওয়েব ম্যাগাজিনে কিছু ছবি ইন্টারনেট থেকে ব্যবহৃত হতে পারে। তাদের দিকে আমাদের আত্মিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। এই ম্যাগাজিনে তথ্য এবং মন্তব্যসমূহ লেখক/লেখিকাদের দ্বারা প্রদান করা হয়েছে, প্রকাশক/সম্পাদক কোনো বার্তা, মন্তব্য, ভুল অথবা বিষয় অসম্পূর্ণতা সম্পর্কে কোনও দায়বদ্ধতা গ্রহণ করেন না।
কপিরাইট © ২০২৫.
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত: রংরুট.কম
ডিজাইন ও ডেভেলপ করেছে: উইকিইন্ড
রক্ষণাবেক্ষণ: টিম রংরুট