Du Chakay Saranda

দুচাকায় সারান্ডা

সরোজ মজুমদার

বসন্তে বাঙালির প্রিয় পলাশ ফুলের ‘রাঙা হাসি রাশি রাশি’ দেখতে যাওয়ার প্রিয় জায়গা হল পুরুলিয়া ও বাঁকুড়া। প্রতিবার একই জায়গায় যাবার একঘেয়েমি কাটাতে এবারে ঠিক করেছিলাম পার্শ্ববর্তী রাজ্য ওড়িশা ও ঝাড়খণ্ডের জঙ্গল মহলে যাব পলাশ দেখতে দোলযাত্রার শুভ লগ্নে ভোর তিনটেয় বাইক নিয়ে কলকাতার বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম। কোলাঘাট-খড়্গপুর পেরিয়ে লোধাশুলি ফরেস্টে ঢোকার পর আবছা দিনের আলো আসতে শুরু করল। সেই স্বল্প আলোতেই বোঝা যাচ্ছিল অরণ্যে কচিপাতার বাহার। ৪৯নং জাতীয় সড়ক ধরে সুবর্ণরেখা নদীর জামশোলা সেতু পার হয়ে ঝাড়খন্ড হয়ে ওড়িশায় প্রবেশ করলাম। এরপর বাংরিপোসির দিকে যতই এগোতে থাকলাম রাস্তার দুপাশে লাল পলাশের মেলা শুরু হয়ে গেল। সামনে সুউচ্চ পাহাড়ের রেখা। ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ জেলায় ঠাকুরানী পাহাড়ের কোলে অবস্থিত ছোট্ট এক গ্রাম বাংরিপোসি কলকাতা থেকে ২২৩ কিলোমিটার। পলাশের নেশায় বার বার বাইক রেখে রাস্তার দুপাশের মাঠে নেমে পড়ছিলাম। পাহাড়ের কোলে লাল পলাশের সারি আর বাতাসে ভাটি ফুলের আবেগী গন্ধ মনকে আবিষ্ট করে তোলে।

আস্তে আস্তে সমতলের রাস্তা ছেড়ে বাংরিপোসির পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথে উঠে পড়লাম। শুরুতেই পাহাড়ি পথের একদম বাঁকে পেলাম অপূর্ব সুন্দর মা দ্বারশুনি মন্দির যা ভগবান শিবের উদ্দেশ্যে নিবেদিত। গাছে ছাওয়া এ পথে যেতে প্রচুর বানরের দেখা মেলে। বেলা বাড়তেই রোদের প্রখরতা বেশ টের পাওয়া যাচ্ছিল। পথে একটি কচি সবুজ পাতার শালবনে একটু জিরিয়ে নিয়ে চম্পুয়া, বারবিল হয়ে ৩৯৫কিমি পথচলা শেষ করে ওড়িশার কিরিবুরু হিলটপের হোমস্টেতে পৌছলাম। লাঞ্চ সেরে একটু ঘুমিয়ে নিয়ে বিকেলে বাইক নিয়ে ঝিকরা ওয়াটারফল দেখতে চললাম। পুরোটাই পাহাড়ি পথ এবং শেষ অংশটুকু লালমাটির মেঠো পথ। ঘন সবুজ বনের ছাউনির মধ্যে প্রায় ৭০ ফুট উচ্চতা থেকে জলপ্রপাতটি নেমে আসছে। ঝর্ণার আশপাশে অনেক মানুষজন পিকনিক করছিল, অনেককে আবার ঝর্ণার জলে স্নান করতেও দেখা গেল।

এরপর মেঘাতুবুরু সানসেট পয়েন্টে পৌঁছে দেখি লোকসমাগমে মুখরিত। পড়ন্ত বিকেলের সোনালী আভায় সামনে দিগন্ত বিস্তৃত ঢেউয়ের মত সবুজ পাহাড়ের চূড়ার শ্রেণী দৃশ্যমান; যার জন্য সারান্ডাকে সাতশো পাহাড়ের দেশ বলা হয়। বানরের দল এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছিল। আকাশকে কমলা ও গোলাপী রঙের ছায়ায় পরিণত করে পাহাড়ের আড়ালে সূর্য ডুব দিল। ওড়িশার কেওনঝার ডিসট্রিক্টের কিরিবুরু ও ঝাড়খণ্ডের সিংভূম ডিসট্রিক্টের মেঘাতুবুরু পাশাপাশি দুটি পাহাড়ি অঞ্চল।

সারান্ডায় থাকার জায়গা খুবই কম, কিছু হোমস্টে আর স্টিল অথরিটি অব ইন্ডিয়া সেইলের দুটি গেস্ট হাউস আছে। সারান্ডা ফরেস্টের মধ্যে থাকার জন্য আছে থলকোবাদ ফরেস্ট রেস্ট হাউস। পরদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে চলে এলাম কিরিবুরু হিলটপের সানরাইজ পয়েন্টে। আকাশে তখনও মস্ত বড় রুপোলি চাঁদ ছিল।

মহুল, শাল, পিয়ালের ঘন জঙ্গলের ভিতর থেকে দূরে পাহাড় ও সমতলের শহর দেখা যায়। সকালে সূর্য ওঠা ছাড়াও এখান থেকে রাতের দৃশ্যও খুব সুন্দর। এরপর বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম পাচেরি ওয়াটারফলের উদ্দেশে। জঙ্গলের মধ্যে একটি জায়গায় বাইক রেখে হাঁটা শুরু করলাম। শাল, পিয়াল, মহুয়ার ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে মহুয়া গাছগুলির নিচে প্রচুর মহুয়া ফল পড়ে আছে দেখলাম। সকালবেলা নিস্তব্ধ নির্জন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে রোমাঞ্চকর তিন কিমি পথ হেটে পাচেরি জলপ্রপাতে পৌছলাম। জনমানবশূন্য, কোলাহলমুক্ত প্রকৃতির মাঝে শুধু জলপ্রপাতের গর্জন আর পাখিদের কলরব।

এরপর জঙ্গলের পথে ফিরে বাইক নিয়ে আবারো শুরু হলো এক রোমাঞ্চকর যাত্রা। শালবনের মধ্যে দিয়ে শালপাতায় ঢাকা মাটির উপর দিয়ে উদ্দেশ্যহীন ঘুরতে ঘুরতে অবশেষে পৌছলাম জঙ্গলের মধ্যে নিঃসঙ্গ পুন্ডুল শিবমন্দিরে। মন্দির দর্শন সেরে জঙ্গলের সরু পথে হাঁটা শুরু করলাম পুন্ডুল জলপ্রপাত দেখার জন্য। চারিদিকে বড় বড় পাথুরে বোল্ডারের মধ্যে দিয়ে পুন্ডুল ওয়াটারফলসের জল বয়ে এসে একটি লেকে পড়ছে। জঙ্গলের এই ঠাণ্ডা ও রহস্যময় পরিবেশের মধ্যে মানুষজন চড়ুইভাতি করতে আসেন।

কিরিবুরু হিলটপে ফেরার পথে দেখে নিলাম পাহাড়ের গায়ে অবস্থিত মা গিরি রাজেশ্বরী মন্দির, যেখান থেকে চারিপাশে পাহাড়ের দৃশ্য খুব মনোরম। হোমস্টেতে ঢোকার আগে বন বিভাগের অফিস থেকে অনুমতিপত্রটি সংগ্রহ করে নিলাম। কিছুক্ষণ পরে আমার গাইড এসে হাজির হল।

সারান্ডা ফরেস্টে বাইক নিয়ে যেতে হলে বনবিভাগের অনুমতিপত্র এবং একজন গাইড অবশ্যই সঙ্গে নিতে হবে। গাইডকে বাইকের পিছনে বসিয়ে পাহাড়ি পথে, শালের জঙ্গলের মধ্যেদিয়ে এগিয়ে চললাম ঘাগরিতা ওয়াটারফলসের উদ্দেশে। পেইড পার্কিংএ বাইক রেখে, হেঁটে তারের ঝুলন্ত সেতু পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম ঘন সবুজ অরণ্যের মধ্যে কয়েকটি ধারায় সশব্দে বয়ে চলা ঘাগরিতা জলপ্রপাতের একদম কাছে। জলপ্রপাত থেকে ছিটকে আসা জল গায়ে মেখে ফেরার পথে জলপ্রপাতটির নিচে অনেক পর্যটককে স্নান করতে দেখা গেল। নিকটেই একটি ওয়াটার পাম্পিং স্টেশন রয়েছে। বাইক নিয়ে আবার চলা শুরু। মধ্য দুপুরের নির্জন শালের বনে শুকনো পাতার আরণ্যক গন্ধে সারান্ডায় শিহরণ অনুভূত হতে থাকল। অরণ্যের মধ্যে কিরিবুরু রেলওয়ে স্টেশনটি ঘুরে সারান্ডা ফরেস্টের কোর এরিয়ার চেক পোস্টে পৌছলাম। আমার গাইড দৌড়ে গিয়ে অনুমতি পত্র দেখানোর পর এগিয়ে যাবার নির্দেশ পেলাম।

সারান্ডা এশিয়ার সর্ববৃহৎ শালবন। শুকনো শালের পাতা বিছানো পথে জঙ্গলের মধ্যে একটি ওয়াচ টাওয়ারের নিকট পৌছালাম। বাইক রেখে এখান থেকে কিছুটা হেঁটে চলে এলাম ভালু গুহার কাছে। বড় একটা পাথুরে অংশের নিচ দিয়ে গিয়ে গুহায় প্রবেশের পথ। চারদিকে জঙ্গল; বেশ একটা গা ছমছমে ব্যাপার আর। এর পাশ দিয়ে একটু উপরে গেলে আরেকটি গুহা দেখা যায়।  ভাল্লুককের দেখা না পেলেও, আছে বলে শোনা যায়।

এরপর পৌছলাম থলকোবাদ ফরেস্ট রেস্ট হাউসে চা পানের বিরতির জন্য। এখানে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থাও আছে। পরবর্তী গন্তব্য কিরিবুরু লৌহ আকরিক খনিতে যাওয়ার পথে সারান্ডা ফরেস্টের মধ্যে দিয়ে হুইসেল বাজিয়ে একটি পণ্যবাহী ট্রেনকে যেতে দেখলাম। পড়ন্ত বিকেলের সোনালী আলোয়, লালচে বাদামী বর্ণের লৌহ খনিতে কর্মব্যস্ততা চোখে পড়ল। কোথাও বডাম্পার ট্রাক সারিবদ্ধভাবে আকরিক ভরে নিয়ে গন্তব্যের পথে; আবার কোথাও কনভেয়ার বেল্টে আকরিক চূর্ণ নির্দিষ্ট জায়গায় চলে যাচ্ছে। সূর্যাস্ত দেখার জন্য আবারো পৌছলাম মেঘাতুবুরু সানসেট পয়েন্টে।

তৃতীয় দিন ভোর সাড়ে চারটেয় অন্ধকারের মধ্যেই কিরিবুরু হিলটপ থেকে পাহাড়ি পথে বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম এবং একই পথে চম্পুয়া, বাংরিপোসি, কোলাঘাট হয়ে কলকাতার বাড়িতে ফিরলাম।

হোটেল: অশোক হোমস্টে; কিরিবুরু হিল টপ, ওড়িশা-৭৫৮০৪০. দূরভাষ: ৯৪৩৭৪৬০৫০১। এছাড়া রুম, গাড়ি বুকিং ও খাবার ব্যবস্থার জন্য যোগাযোগ করতে পারেন ভ্রমণ সহায়ক সোনু কুমারের সাথে; দূরভাষ: ৮৬৫৮৫৬২১২৩

 

সাম্প্রতিক সংযোজিত প্রতিবেদন

দ্রষ্টব্যঃ এই ওয়েব ম্যাগাজিনে কিছু ছবি ইন্টারনেট থেকে ব্যবহৃত হতে পারে। তাদের দিকে আমাদের আত্মিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। এই ম্যাগাজিনে তথ্য এবং মন্তব্যসমূহ লেখক/লেখিকাদের দ্বারা প্রদান করা হয়েছে, প্রকাশক/সম্পাদক কোনো বার্তা, মন্তব্য, ভুল অথবা বিষয় অসম্পূর্ণতা সম্পর্কে কোনও দায়বদ্ধতা গ্রহণ করেন না।
কপিরাইট © ২০২৫.
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত: রংরুট.কম
ডিজাইন ও ডেভেলপ করেছে: উইকিইন্ড
রক্ষণাবেক্ষণ: টিম রংরুট