আড়মোড়া ভাঙতে গিয়ে ঘুমটা যখন ভেঙে গেল, বালিশের পাশ থেকে মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখলাম ঘড়িতে সময় রাত তিনটে বেজে দশ মিনিট। উঠতে হবে। কিন্তু কোনও সমস্যা হবে না তো? কারণ বিছানায় আমার পাশে যে দুজন নিঃসাড়ে ঘুমোচ্ছে, তাদের সাথে আমার আজই পরিচয়। পরিচয় হয়ে যারপরনাই ভালো লেগেছে, কিন্তু ঘুমের মধ্যে তো। তার ওপর এই প্রায় মধ্যরাত। যদিও পাহাড়ে আর কিছুক্ষণেই ভোর হবে, হয়তো কিছু মানুষ জেগেও গিয়েছে ইতিমধ্যেই, টাইগার হিলের গাড়িগুলো ট্যুরিস্ট তুলতে হয়তো হোটেলের সামনে পৌঁছেও গিয়েছে, কিন্তু আমরা যারা শহরের মানুষ তাদের কাছে এটা বাস্তবিকই মধ্যরাত। তাতে তারা বা হোটেলের লোকজন যদি আমাকে দেখে অন্য কিছু ভেবে নেয়, তখন? যদি বাইরে কুকুর ছাড়া থাকে সেক্ষেত্রে? কিন্তু আমারও তো ওঠা ছাড়া কোনও উপায় নেই।
কারণ আমার যন্ত্রশকটটিকে একবার স্টার্ট করতেই হবে। তার ব্যাটারি কদিন আগেই একবার দেহ রেখেছিল। তিন-চার দিন কোমাতে থাকবার পর কোন শুভক্ষণে অদৃশ্য মন্ত্রবলে সে জেগে উঠেছে। তাই তাকে আমাকে মাঝেমধ্যেই জাগিয়ে নেড়েচেড়ে দেখতে হবে যেন সে আবার কোমায় না চলে যায়। এরমধ্যেই পাঁচঘন্টা পেরিয়ে গিয়েছে। বাড়ি থেকে যখন বেরিয়েছিলাম ঠিক করে নিয়েছিলাম যে গাড়ি যখন থামা অবস্থায় থাকবে তখন দুঘন্টা বাদে বাদে গাড়ি স্টার্ট করবো। সেই হিসেব মেনে শেষ দশটায় গাড়ি স্টার্ট দিয়েছিলাম, মোবাইলে এলার্মের ঘন্টা সেট করা ছিল বারোটায়। যথারীতি ঘুম ভাঙে নি। তাই এখন, যাই হয়ে যাক না কেন, উঠতে আমাকে হবেই।
আওয়াজের ভয়ে অতি সন্তর্পণে দরজা ঠেলে বেরুলাম। দরজায় আওয়াজের যে ভয় পেয়েছিলাম তার বিন্দুমাত্র হল না। ঝাঁ চকচকে ন্যাচারস প্যারাডাইস রিসর্ট খুবই ওয়েল মেইন্টেইন্ড। কিন্তু বাইরের এ কী অবস্থা। যদিও প্রায় এইরকম অবস্থাতেই গতকাল সন্ধেতে আমরা এখানে এসে ঢুকেছি। সেটাই এখন আরো তীব্র হয়ে উঠেছে। এতটাই যে ঘর থেকে মেঘের মতো ভেসে যাওয়া কুয়াশার জন্য একটু দূরে রাখা গাড়িটাকেও আর দেখা যাচ্ছে না।
পা টিপে টিপে এগুতে লাগলাম। পাছে বিশাল কোনও সারমেয় ব্যাঘ্রসম গর্জন করে না আমার দিকে তেড়ে আসে। ঢোকার সময়ই দেখেছি গেটে একখানা রটহুইলারের ছবি দিয়ে সাবধানবাণী দেওয়া আছে। ঠান্ডা খুব একটা লাগছে না, কারণ ফুটন্ত জ্বলন্ত সমতল থেকে কাল বিকেল নাগাদ এখানে উঠে এসে যে ঠান্ডা আর কুয়াশা পেয়েছি মনের সাথে শরীরও তা পুরোপুরি টেনে মানিয়ে নিয়েছে। ঘরের সামনে ল্যাম্পপোস্টের আলোগুলোকে মনে হচ্ছে সারারাত যেন যুদ্ধ করবার পর তারা এখন জাস্ট টিকে থেকে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। দুগগা দুগগা বলে সিটে বসে চাবিটা লাগিয়ে ইগনিশনের পরে ঘুরিয়ে গাড়িটা যখন একবারে স্টার্ট নিয়ে নিল, ঘাম দিয়ে জ্বর নেমে গেল যেন গা থেকে। পেরেছে…পেরেছে… আমার ছোট্ট গাড়ি পেরেছে। দু ঘন্টার পরেও সে একবারে পেরেছে। ঘড়িতে এখন সাড়ে তিনটে। তার মানে পরের স্টার্ট দেবার সময় সাড়ে পাঁচটে। তখন রোদ উঠে আলো খেলে পুরোপুরি সকাল হয়ে যাবে পাহাড়ে। তখন আর চাপ নেই।

কিন্তু চাপ নেই বললেই কি আর চাপ নেই হয়? হঠাৎ কী মনে হল যে এই মেঘ কুয়াশায় ঢাকা রিসর্টটার একখানা ছবি তুলি। পকেট থেকে মোবাইল বের করে ছবি তুলে যেই না সেটাকে স্ক্রীনে দেখতে গিয়েছি দেখি তাতে কুচকুচে কালো এক বেড়াল। ও বাবা, এ তো ছিল না যখন ছবি তুলি। এই ভাবতে না ভাবতেই পায়ের সামনে ম্যাঁও। তড়াক করে লাফিয়ে উঠে দেখি সত্যিই এক মার্জার একদম পায়ের সামনে। বুকের রক্ত জল হয়ে ভিরমি খেয়ে গিয়েছিলাম আরেকটু হলেই। কোনওক্রমে সামলে নিতে নিতে দেখলাম সে এগুচ্ছে কিচেনের দিকে। যাও বাবা…যাও…রক্ষে কর…আরেকটু হলেই তুমি আমাকে কুপোকাত করে দিয়েছিলে আর কি!
আসলে এসবেরই শুরুয়াত সেই জর্জ ম্যালোরির বিখ্যাত কথাটা দিয়ে- because it is there। তাই বাড়িতে আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুবান্ধব এলে সবাই মিলে ছোটো পাহাড়ে। আবার এমন যদি হয় যে তারা এসে ঢুকেছেই একেবারে পাহাড়ে আর সেখান থেকেই জানিয়েছে চলে আসার উষ্ণ আহ্বান তাহলেও একই। ছোটো পাহাড়ে। এরকমভাবেই গ্রুপে ঘুরতে গিয়ে প্রথমে বৌ-এর, তারপর আমার সাথে ফোনে পরিচিত এক দম্পতি পাহাড়ের ঠান্ডা খেতে এসে উঠেছিল মিরিকে। তারপর সেখান থেকে গিয়ে আপাতত তারা ঘাঁটি গেড়েছে লেপচাজগতে। আর প্রোগ্রাম হয়েছে এমন যে আমরা গিয়ে তাদেরকে সেখান থেকে পিকআপ করে সবাই মিলে চলে যাব দাওয়াইপানি।
প্রোগ্রাম ঠিক করতে গিয়ে বহুদিন পর দরকার পড়েছে অরিজিতের ফোন নম্বরের। সে ছেলে একসময় ইঞ্জিনীয়ারিং পড়তো আর কবিতা লিখতো। তারপর এখন দাওয়াইপানিতে হোমস্টে বানিয়ে দিবারাত্র পরিশ্রম করে যাচ্ছে। গেস্টদের জন্য গুচ্ছের রান্না করছে। যাইহোক এসবই আগে ফেসবুকে অরিজিতের পোস্ট থেকে জানা। এখন ওর ওখানে থাকবো ভেবে মেসেঞ্জারে ওর কাছ থেকে নম্বর নিয়ে ফোন করে জানলাম পরদিন ওর ফুল বুকড। যদি আমরা চাই তাহলে ও পাশের রিসর্টে বলে দিতে পারে। অতএব তাই সই। কাল ছাড়া বৌ-এর আর তারিখ মিলছে না। অরিজিতও বলে দিল সেখানে আর পরদিন সকালে আমরাও বেরিয়ে পড়লাম পাহাড়ের উদ্দেশ্যে।
ওহ…মাঝখানে শুধু একটাই কাজ। শিলিগুড়ি থেকে একজনকে পিকআপ করতে হবে। সেও ওই ঘোরার সূত্রেই বৌ-এর পরিচিত ভাই। যাইহোক কোনওক্রমে তাকে খুঁজে পেতে যোগাড় করে গাড়ি ছুটলো পাহাড় অভিমুখে। আহা…সেই রাস্তার ভাঁজ পাহাড়ি যুবতীর শরীর। আর তার সিল্কি চুলের খাঁজে খাঁজে লুকোনো কুয়াশা, পাইনবন। এভাবেই পেরিয়ে গেলাম একে একে থরবু, গোপালধারা- এইসব চা বাগান। সবই ঠিক ছিল কিন্তু মিরিক বাইপাস থেকে সামান্য এগোতেই এমন মেঘের রাজ্যে পড়লাম যে আর কহতব্য নয়। ইন্ডিকেটর-হেডলাইট সব জ্বালিয়ে চলতে হচ্ছে। এই কুয়াশায় খুঁজে পাবো তো তাদেরকে? যারা লেপচাজগতে আমাদের অপেক্ষায় জন্য বসে আছে?

এই সবের মুশকিল আসানের জন্য এখন হাতের কাছেই তো রয়েছে মোবাইলের ম্যাপ। সেখানেই কোন জায়গা কত দূর সবেরই আছে হাতে গরম হদিশ। আর মখমলের মতো মোলায়েম রাস্তাতেও দেখলাম এখন সব জায়গারই নাম লেখা আছে বা আছে মাইলপোস্ট। তাই কোনও সমস্যাই হল না। গুফাপাতাল, সীমানা পেরিয়ে চলে এলাম লেপচাজগত। আর সবাইকে তুলে নিয়ে বকর বকরের মধ্যেই গাড়ি ছুটলো দাওয়াইপানি।
এবারে দাওয়াইপানি কোন দিকে? ভারতের যে সর্বোচ্চ রেলস্টেশন ঘুম তার একদিকে রাস্তা গিয়েছে দার্জিলিঙের দিকে, আরেকদিকে গিয়েছে বিজনবাড়ি, লেপচাজগত বা সুখিয়াপোখরির দিকে আর আরেকদিকের রাস্তা এসেছে শিলিগুড়ির দিক থেকে। এই শিলিগুড়ির দিকে ঘুম থেকে খানিক পিছিয়ে আসলেই জোড়বাংলো মোড়। এই জোড়বাংলো মোড় থেকেই একখানা রাস্তা চলে গিয়েছে সিকিম বা কালিম্পঙের দিকে। সেই রাস্তা ধরে খানিক এগোলেই দাওয়াইপানি। আবার এই রাস্তাতেই লামাহাটা, তাকদা, তিনচুলে।
এদিকে গাড়ি যখন ঘুমের খুব কাছাকাছি, ঘড়িতে সময় প্রায় আড়াইটে তিনটে বাজে, কন্যা জানালো কিছু না খেয়ে সে আর এগোতেই পারবে না। তাই ঘুমের আগে ছোট্ট এক দোকানে দাঁড়িয়ে খাবারের দোকানের খোঁজ করতেই দোকানি জানালো রুটি খেলে সে করে দিতে পারে। অতএব তাই সই। গরম গরম রুটি, পরিমাণে কম হলেও আচার-আলুভাজা সব মিলিয়ে সবারই মোটামুটি লাঞ্চ হয়ে গেল।
কিন্তু পাহাড় তো, গাড়ি সাইডে রাখলেও সেখান থেকেই জ্যাম। পুলিশ প্রায় ছুটে এসে ফাইন করে দেয় আর কি। কোনক্রমে সে সব কিছুর পাশ কাটিয়ে যখন দাওয়াইপানির উদ্দেশ্যে সিকিম-কালিম্পঙের রাস্তা ধরলাম তখন বেলা প্রায় চারটে। এ রাস্তা অনেকটাই ফাঁকা। খুঁজতে খুঁজতে চলেছি। আমাদের রাস্তায় পড়বে ছয়মাইল নামের একটি জায়গা। সেখান থেকেই ওপরে রাস্তা উঠে গিয়েছে দাওয়াইপানির দিকে। যাইহোক ছয়মাইল আর যেতে হল না। তার আগেই বোর্ড দেখে গাড়ি নিয়ে পৌঁছে গেলাম ন্যাচারস প্যারাডাইস রিসর্টে। আর চেক ইনের সাথে সাথেই এসে গেল চমৎকার দার্জিলিঙ পাতার চা যা খেয়ে এতক্ষণ পথের ক্লান্তি, গাড়ি চালানোর ক্লান্তি সব যেন নিমেষে দূর হয়ে গেল। ততক্ষণে মেঘের রাজ্যে ডুব দিয়েছে চারিদিক।
দুটো ঘর নিয়ে ঠিক হল যে একটাতে আমরা ছেলেরা ঢুকে যাবো আরেকটাতে মেয়েরা-বাচ্চারা থাকবে। সন্ধেটা চা আর পকোড়া দিয়ে জাস্ট জমে গেল। সাথে চলল দেদার আড্ডা। মাঝে একটু সময়ের জন্য এসে দেখা দিয়ে গেল অরিজিত। রাতের মেনু ছিল ফ্রায়েড রাইস আর চিলিচিকেন।

এবারে সেই মার্জারকে পাশ কাটিয়ে যখন প্রায় ঘরের সামনে হঠাৎ মনে হল দার্জিলিঙকে একবার দেখে এলে কেমন হয়। মানে দাওয়াইপানির ঠিক বিপরীতে দার্জিলিঙ, আর এই রিসর্টেরই কিছু ঘর আছে একটু ওপরে যেখান থেকে তাকে দেখা যাবে। অতএব চল। অবাক কান্ড, গিয়ে দেখি রাতের আকাশের তারার মতো ঝকঝক করছে রাত সাড়ে তিনটের দার্জিলিঙ। এদিকটায় মেঘ বা কুয়াশা থাকলেও ওদিকটা একদম ঝকঝকে পরিষ্কার।
কিন্তু পাহাড়ের তো ভরসা নেই। কথা দিয়ে কথা না রাখাই যেন তার নিয়ম। দুই পাহাড়ের মাঝখান থেকে কীভাবে মেঘ এসে মুহূর্তের মধ্যে সব ঢেকে দিল। আর আমিও বৃথা কালক্ষেপ না করে লেপের তলায় গিয়ে সেঁধোলাম।
পরদিন কী ঘটেছিল? তা জানতে হলে সম্পাদকের অনুমতি নিয়ে বাকি গল্প বলা যাবে। তবে তা এমন গল্প যা কখনই নিরাশ করবে না।
দাওয়াইপানিতে থাকার জন্য যোগাযোগ করতে পারেন- অরিজিত (গ্রীন হিল স্টে)-৮৩৪৫০৮৬২০০, ন্যাচারস প্যারাডাইস রিসর্ট- ৯৩৮২৮০৫২৪৪