করোনা এসে ২০২০ সালটা ওলটপালট করে দিল, যার ফলে সেই ভাবে ট্রেক করা হয়নি। তাই ২০২১-তে খুব আশা জাগল যে একটা ঠিক মতন ট্রেক প্ল্যান করতে হবে। কিন্তু সে গুড়ে বালি, ২০২১-এর প্রথম কয়েক মাস তো আরও বেশি করে করোনার বিধিনিষেধ শুরু হলো। প্রায় সব জায়গায় যাতায়াত বন্ধ। সিকিম, উত্তরাখন্ড, হিমাচল, লাদাখ, সব জায়গায় প্রচন্ড কড়াকড়ি। খোলা বলতে একমাত্র নর্থ বেঙ্গল। কিন্তু ২০২০ জানুয়ারি থেকে ২০২১-এর জানুয়ারি আমাদের চারবার সিঙ্গালিলা যাওয়া হয়ে গেছে। তাই এবার ইচ্ছে করছিল নতুন কোনো জায়গায় যেতে। পুজোর ছুটির কথা ভেবে ট্রেনেরতিনটে স্লিপার ক্লাস টিকিট আগাম কাটা ছিল নিউ জলপাইগুড়ির। কিন্তু কী হবে কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না। তবে সেপ্টেম্বর নাগাদ দেখলাম পরিস্থিতি বেশ খানিকটা শিথিল হলো এবং সিকিম সরকার ট্যুরিজম আবার শুরু করল। অতএব পুরনো একটা ইচ্ছে আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। বহুদিনের একটা ইচ্ছে, নর্থ সিকিমের একটা ট্রেক রুট ফেরহাতছানি দিতে শুরু করল।

প্ল্যান শুরু হয়ে গেল লাসার ভ্যালি যাবার। কিন্তু বললেই তো হলোনা! নর্থ সিকিম বরাবরই বেশির ভাগটাই রেস্ট্রিক্টেড এরিয়া, গাড়ি নিয়ে ঘুরতে যাওয়াতেই অনেক রকম পারমিশন লাগে। সেখানে ট্রেকের পারমিশন বের করা তো আর একটু জটিল হবেই। সুজয়দাকে ফোন করলাম, সুজয় দাস যিনি ট্রেকিং জগতের খুব পরিচিত এবং বিখ্যাত নাম, সিকিম এবং নেপাল সরকারের সাথেও যাঁর অনেক কাজ রয়েছে হিমালয়কে ঘিরে, ওনার কাছ থেকে জনৈক মিঃডিকে ঘটানি-র ফোন নম্বর পেলাম, উনি বললেন যে ডিকে-র সাথে কথা বলো, ও হয়তো কিছু করতে পারবে।
ডিকে বললেন যে উনি ব্যবস্থা করে দেবেন। সেই অনুযায়ী প্রস্তুতি শুরু হলো। যেহেতু এটা বেশি উচ্চতার ট্রেক তাই ঠিক হলো আমরা সোজাসুজি লাচেন থেকে ট্রেক শুরু না করে আরেকটু এগিয়ে থাঙ্গুতে থাকব, আর সেখান থেকে ট্রেক-এর উদ্দেশ্যে বেরোব। নির্ধারিত দিন উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেসে উঠে পড়লাম, ছোট্ট টিম, তিস্তা, শ্রীমতি আর আমি।
প্রথমদিন -এনজেপি স্টেশন থেকে ১৪৩ কিমি দূর সিঙ্ঘিক-এ আমা হোমস্টেতে পৌঁছে গেলাম, মালিক জিগমিজী প্রচুর অর্কিড আর অন্য অনেক গাছ দিয়ে খুব সুন্দর সাজিয়েছেন জায়গাটা।
দ্বিতীয়দিন - ২০১৫ তে যখন নর্থ সিকিম গেছিলাম তখন সিঙ্ঘিক থেকে বিকেলের দিকে বিশাল বড় কাঞ্চনজঙ্ঘা রেঞ্জ দেখেছিলাম। তাই এবারেও মনে আশা নিয়ে ভোরবেলা উঠে পড়লাম। নিরাশ হতে হলো না, মন পাগল করা রঙের খেলা দেখিয়ে সূর্যোদয় হলো মনোময় কাঞ্চনজঙ্ঘা হিমালয়ে। দুপুরের দিকে ডিকে নিজেই গাড়ি নিয়ে এলো সিঙ্ঘিকে, সঙ্গে নিয়ে এলো গ্যাংটক-এর মিংমা ভাইকে।সে-ইআমাদের সাথে এই ট্রেকটায় গিয়েছিল। একটু দেরি হয়েছিল ওদের আসতে। তার উপর আবার রাস্তায় ভালো জ্যাম কাটিয়ে আমরা ৫২ কিমি দূর লাচেন পৌঁছলাম প্রায় রাত ৯ টার সময় । থাকার ব্যবস্থা আগে থেকেই করা ছিল হোটেল Zoumsa তে।

তৃতীয়দিন - আমরা সকাল বেলা বেরিয়ে পড়লাম লাচেন থেকে। এদিন আমরা ৬৬ কিমি দূরে ১৭৮০০ ফিট উচ্চতায় অবস্থিত গুরুদংমার লেক দেখে ফেরার পথে থাঙ্গুতে এসে থাকলাম। থাঙ্গুতে থাকার জায়গা খুবই সীমিত, মাত্র ২-৩ টে হোমস্টে আছে যার মধ্যে একটিতে আমরা উঠলাম। এই সব কিছুই ডিকে আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিল। বিকেলের দিকে লাচেন থেকে নিজের গাড়িতে এসে পৌঁছলো আমাদের টীম-এর আসল লোক, ফুচুঙ লাচেনপা। পরে জেনেছিলাম ফুচুং WWF-এর সাথে কাজ করে এবং নর্থ সিকিম-এর বেশির ভাগ জায়গাতেই,যার মধ্যে বেশ কিছু ১৭০০০-১৮০০০ ফিট-এর পাসও রয়েছে, সব সময় ঘুরে বেড়ায় ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফির জন্য। ফুচুং-এর সাথে এসেছিল তেনজিঙ লাচেনপা এবং ছানজুক লাচেনপা। ফুচুং বললো দুটো রুট আছে ফালুঙ যাবার, একটা থাঙ্গু থেকে উঠে গেছে ফালুঙ অব্দি আর একটা থাঙ্গু থেকে ৪৫ মিনিট মতন গাড়ি করে গিয়ে ১৫৫০০ ফিট-এ অবস্থিত ঘোচুঙ বলে একটা জায়গা, যেখান থেকে ট্রেক করে যেতে হয় ১৬৫০০ ফিট Ladey La, সেখান থেকে ফালুঙ হয়ে আবার থাঙ্গু নেমে আসা। কথা বলে ঠিক করা হলো যে আমরা দ্বিতীয় রুটটায় যাব।

চতুর্থদিন- থাঙ্গু থেকে আমরা গাড়িতে যাত্রা শুরু করলাম গুরুদংমার লেক-এর দিকে, আধ ঘন্টা মতন যাবার পর একটা মিলিটারি পোস্ট চোখে পড়ল, যেখানে হাইট লেখা ছিল ১৫০০০ ফিট। এর মিনিট ১৫ বাদে আমরা নামলাম একটা জায়গায়। আশপাশে প্রচুর মিলিটারি ট্যাঙ্ক আর সাঁজোয়া গাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছিল। এই জায়গাটার লোকাল নাম ঘোচুঙ, হাইট ১৫৫০০ ফিট মতন। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে Lachen Chu নদীযেটা তিস্তা নদীর প্রধান উপনদী, আর নদীর অপর পারেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে শ্বেতশুভ্র Kanchangyao পর্বত। গাড়ি থেকে নেমে জিনিসপত্র ঠিকঠাক করে নিয়ে সকাল ১০টা নাগাদ আমাদের ট্রেক শুরু হলো, প্রথমেই একটি ছোট অস্থায়ী ব্রিজের ওপর দিয়ে লাচেন চু নদী পেরিয়ে গেলাম, এরপর থেকেই রাস্তা উঠে গেছে ১৬৫০০ ফিট LadeyLa টপ এর দিকে।

অনেকটা উচ্চতায় ট্রেকটা শুরু বলে অল্প বিস্তর সবার একটু অস্বস্তি ছিল কিন্তু খুব একটা অসুবিধে হচ্ছিল না।রাস্তা চলেছেএকেবারে Kanchangyao পর্বতের পাশ দিয়ে, নিচে দেখা যাচ্ছে লাচেন চু নদী, তার পাশ দিয়ে চলে গেছে গুরুদংমার হাইওয়ে, উল্টো দিকে দেখা যাচ্ছে Chumangkhang আর Chomoyomo পর্বত। পেছন দিকে দেখা যাচ্ছে তিব্বতী মালভূমি, আরো খানিকটা যাবার পর বেশ জোর একটা আওয়াজ শুনে চমকে দেখি Chumangkhang পর্বতে avalanche অর্থাৎ বরফের ধস নামলো। আরো কিছুটা চলার পর দূর থেকে দেখা গেল Ladey la টপ।সেইখান দিয়ে পেরিয়ে আমরা Phalung এর দিকে নেমে যাবো।

চুংথাং থেকে গুরুদংমার লেক এই চত্বরে চট করে Kanchendzonga পর্বত দেখা যায়না। নর্থ সিকিম-এর পাহাড়গুলো এতটাই উঁচু এবং কাছে যে তার পেছনে ঢেকে যায়। আমাদের আগে খুব অল্প যে কজন গিয়েছিল এই রুটে তারাও কেউ দেখেনি, কিন্তু তবু আমরা আশা করেছিলাম যেহেতু অনেকটা ওপর দিকে উঠব তাই হয়তো দেখা যেতে পারে। খানিকটা এগনোর পর হঠাৎ তিস্তা খুব উত্তেজিত হয়ে আমাদের সোজাসুজি একটু ডানদিকে হাত দিয়ে দেখিয়ে বলল "ওই তো Kanchendzonga"। বলেই প্রণাম করে নিল। আমরা ওর সাথে সাথে দেখলাম বেশ বড় বরফে ঢাকা পাহাড় দেখা যাচ্ছে এবং যেটা দেখে Kanchendzonga বলেই মনে হচ্ছে, মনে হচ্ছে বললাম কারণ এই ফেসটা আমরা আগে কোনোদিন দেখিনি আর দার্জিলিং, সিঙ্গালিলা, গ্যাংটক বা সিঙ্ঘিক থেকে যেরকম দেখা যায় তার থেকে বেশ খানিকটা আলাদা। কিন্তু তবু অতটা উঁচু, পুরো সাদা আর চুড়োটা দেখে মনে হচ্ছিলো এটা Kanchendzongaই হবে।

আমাদের দলের বাকি তিন জন আগেই এগিয়ে গেছিল। তাই মনে একগাদা আশা নিয়ে একটু পা চালিয়ে চললাম পরের বিশ্রামের জায়গার দিকে।সেখানে ওদের জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হওয়া যাবে। অবশেষে ফুচুং বললো যে আমরা ঠিকই চিনেছি, এবং সেই আনন্দে কফি, চকলেট দিয়ে একটা ছোট্ট পার্টি সেরে নেওয়া হলো Ladey La পৌঁছনোর খানিকটা আগে। রাস্তা খুব একটা খারাপ নয়, শুধু উচ্চতাটাই কষ্টদায়ক, ওই উচ্চতায় খুব তাড়াতাড়ি হাঁটা সম্ভব নয়, তাই মোটামুটি গতিতে হেঁটে অবশেষে বিকেল ৩.৩০ নাগাদ আমরা পৌঁছে গেলাম Ladey La টপ-এ।

পাস-এর ওপর বেশ কিছু পাথরের ওপর পাথর সাজিয়ে কেয়ার্নস বানানো। আর একটু বড়ো পাথরের স্তুপে কিছু বুদ্ধিস্ট ফ্ল্যাগ লাগানো রয়েছে। আকাশে তখন ভালোই মেঘ এসে গেছে, ফালুঙ-এর দিকে Chombu পর্বতশ্রেণী আধা আধা দেখা যাচ্ছে মেঘের ফাঁক দিয়ে, যেদিক দিয়ে উঠে এসেছি সেদিকে দেখা যাচ্ছে Chumangkhang আর Chomoyomo পর্বত, তার পেছন দিকে তিব্বতী মালভূমি।
প্রকৃতির উদ্দেশে পুজো দিয়ে আমরা নেমে চললাম ফালুঙ-এর দিকে। অনেকটা ওপর থেকে ফালুঙ দেখা যাচ্ছে। আমাদের নামতে হবে প্রায় ১৫০০ ফিট মতন। সামনের দৃশ্য আরো পাগল করা। নিচে দেখা যাচ্ছে বিরাট ভ্যালি যেটাকে ফালুঙ বলা হয়, সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে Chombu পর্বতশ্রেণী। বাঁ দিকে ক্রমশ আরো যেন কাছে চলে আসছে Kanchengyao পর্বত। এইসব দেখতে দেখতে আমরা বিকেল ৪.১৫ নাগাদ ফালুঙ পৌঁছলাম। খানিকক্ষণ পর আশপাশ মেঘে ঢেকে গেল এবং সূর্য অস্ত গেল। আমরা তিনজন ছিলাম একটা তাঁবুতে, আর বাকি চারজন ঢুকে পড়ল একটা Yakmen hut এ। ফালুঙ-এ প্রতিবছর সিকিম-এর বিখ্যাত ইয়াক ফেস্টিভ্যাল আয়োজিত হয়, সেইজন্য বেশ কয়েকটা পাথর দিয়ে তৈরি Yakmen দের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে।

পঞ্চমদিন- ভোরবেলা আবার দেখা গেল Kanchendzonga পর্বত-এর ওপর সূর্যাস্তের প্রথম আলোতে রং-এর খেলা। তিস্তা খুব ক্লান্ত ছিল,ঘুম থেকে উঠতে পারছিলনা। তাই ওকে তাঁবুতে রেখেই আমি আর শ্রীমতি এগিয়ে চললাম ফুচুং-এর সাথে সামনের রিজটার দিকে। যার ওপর উঠলে দেখা যাবে নিচ দিয়ে বয়ে চলা যাচু নদী যেটা থাঙ্গুতে গিয়ে মিশেছে Lachen চুর সাথে। বাঁদিকে মনে হচ্ছে হাত বাড়িয়ে ছোঁয়া যাবে Kanchengyao পর্বতকে, সামনে Chombu, ডান দিকে Kanchendzonga-র পাশে দেখা গেল আর একটি বেশ বড় সাদা পাহাড়।সেটার নাম কিরাত চুল্লি বা Tent Peak, যদিও তা আমরা পরে কলকাতায় ফিরে এসে আমাদের এক সিনিয়র বন্ধু প্রতীক মুখার্জী যিনি আর একজন সিকিম স্পেশালিস্ট তাঁর কাছ থেকে জেনেছিলাম।
রিজটার ওপর পৌঁছে নিচে দেখা গেলো যাচু নদী, প্রথম দেখাতে মনে হলো নীলচে সবুজ রঙের একটা অপূর্ব দেখতে সাপ এঁকে বেঁকে চলেছে। আমাদের অবস্থানটা তখন এইরকম, সামনে Chombu পর্বতশ্রেণী,বাঁদিকে Kanchengyao পর্বত, ডানদিকে Kanchendzonga আর Kirat Chulli পর্বত, পেছনদিকে ফালুঙ তারপর Ladey La আর তার পেছনে Chumangkhang আর Chomoyomo পর্বত, আর নিচে দিয়ে বয়ে চলেছে মনোমুগ্ধকর যাচু নদী।
বেশ কিছু ছবি তোলার পর ফিরে চললাম ক্যাম্পের দিকে। এরইমধ্যে বেশ কিছু জংলি ইয়াক আর ঘোড়া দেখা গেল আমাদের ক্যাম্প সাইটের আশপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এদিন আমরা নেমে যাবো থাঙ্গুর দিকেই আর একটা ক্যাম্পে, যার চলতি নাম দামিচে। ক্যাম্প গুটিয়ে, আশপাশের জায়গা পরিষ্কার করে আমরা সকাল ১০.৩০ নাগাদ হাঁটা চালু করলাম। পাশ দিয়ে খানিকটা নিচে বয়ে চলেছে যাচু নদী, ফুচুং আমাদের হাত দিয়ে দেখালো উল্টোদিকের একটা পাহাড়ে এক দল ভরাল ঘুরে বেড়াচ্ছে। খালি চোখে কিছুই দেখতে পেলাম না, আন্দাজ করে ছবি তুলে নিলাম, পরে জুম্ করে দেখেছিলাম প্রায় ৬০-৭০ টা ভরালের ছিল দলটা। এদিন আমাদের হাঁটা আগের দিনের তুলনায় কম, দূর থেকে দেখা গেলো ক্যাম্পসাইট। রাস্তা কিছুকিছু জায়গায় পাথর দিয়ে বাঁধানো, দুপুর ২.৩০ নাগাদ পৌঁছে গেলাম দামিচে। এখানে একদম পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে যাচু নদী, সামনে Chombu পর্বতশ্রেণী, ঘাসের গালিচা বিছানো বেশ সুন্দর একটা ক্যাম্পিং গ্রাউন্ড, সন্ধের একটু পরেই ডিনার করে শুয়ে পড়লাম। রাত্রে তাঁবুর পাশে কোনো এক প্রাণীর পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেছিল বেশ কয়েকবার। সকালে উঠে জানা গেল যে হিমালয়ান ফক্স, পড়ে থাকা খাবারের লোভে এসেছিল।
ষষ্ঠদিন - এই দিন আমরা নেমে যাবো থাঙ্গু।সেখান থেকে লাচেন গিয়ে রাত্রিবাস। আগের দিন সন্ধের পর থেকেই দামিচে-তে বৃষ্টি শুরু হয়েছিল,আজও আকাশের মুখ ভার। আমরা সকাল ৯.১৫ নাগাদ হাঁটা শুরু করলাম, মাঝে মধ্যেই বৃষ্টি হচ্ছিল, আকাশ বেশ ভালোই অন্ধকার। ১২.১৫ নাগাদ আমরা পৌঁছলাম Gyamzi বলে একটা জায়গায় যেখানে গাড়ি এল আমাদেরকেথাঙ্গু নিয়ে যাবার জং।থাঙ্গু থেকে ফুচুং ওর নিজের গাড়িতে করে আমাদের সবাইকে নিয়ে লাচেন পৌঁছে দিল। সেদিন রাতেও ভালোই বৃষ্টি হচ্ছিল, লাচেন-এউঠলাম হোটেল স্নো লায়ন-এ।
ট্রেক ভালোয় ভালোয় শেষ হলেও এই টুর-এর গল্প তখনও বাকি ছিল, যেটা আমরা পরে বুঝেছিলাম। লাচেন থেকে পরদিন আমরা পৌঁছলাম গ্যাংটক। প্ল্যান ছিল গ্যাংটকেদুই রাত্তির কাটিয়ে তারপর ট্রেন ধরব এনজেপি থেকে। গ্যাংটক যাবার পথে রাস্তায় ভালোই বৃষ্টি পেলাম, হোটেলে ঢুকলাম বিকেল চারটে নাগাদ, একটু ফ্রেশ হয়ে বৃষ্টির মধ্যেই ঘুরতে গেলাম এমজি মার্গে। বেশির ভাগ দোকান ততক্ষণে বন্ধ হতে শুরু করে দিয়েছে বৃষ্টির জন্য। অগত্যা আমরা ছটা নাগাদ ওই বৃষ্টির মধ্যেই যাহোক করে ফিরলাম হোটেলে।তখনোবুঝিনিআমাদের জন্য এই টুরে আরো কী চমক অপেক্ষা করে আছে।
২০ অক্টোবর ২০২১ আমাদের ট্রেন ছিল এনজেপি থেকে।১৮ তারিখ সন্ধে ছটা থেকে তুমুল বৃষ্টি শুরু হলো এবং সেই বৃষ্টি একবারের জন্যেও না থেমে ১৯ তারিখ পুরো দিন ধরে চললো, ২০ তারিখ সকাল ১০টা বাজে তখনো বৃষ্টি হয়েই যাচ্ছে। খবর এলো যে গ্যাংটক শিলিগুড়ি হাইওয়ে বন্ধ হয়ে গেছে, তিস্তার জল রাস্তায় উঠে এসে বেশ কিছু জায়গা ভেঙেও দিয়েছে, সিকিম থেকে কোনো গাড়ি সরাসরি শিলিগুড়ি যেতে পারছেনা। ওদিকে কালিম্পঙ-এরও একই হাল, একমাত্র দার্জিলিং হয়ে কিছু গাড়ি নামছে, কিন্তু অনেক সময় বেশি লাগছে। রাস্তায় মারাত্মক জ্যাম এবং গাড়ি ভাড়া প্রায় ৪-৫ গুণ বেশি লাগছে।
আমরা প্রথমে খানিক মুষড়ে পড়লাম, কারণ এই অবস্থায় নেমে গিয়ে এনজেপি পৌঁছে ট্রেন ধরা যাবে বলে মনে হলোনা।ডিকে'র সাথে কথা বলেওবোঝা গেল যে আমরা ট্রেন কোনোমতেই ধরতে পারবোনা। অগত্যা টিকিট ক্যানসেল করে অনেক ঘুরপথে আমরা রওনা দিলাম দার্জিলিং। পথে দেখলাম বেশ কয়েকটা ঝোড়াতে তুমুল বেগে জল বইছে, প্রচুর জায়গায় পাহাড় ধসে গেছে, বেশির ভাগ রাস্তা যেখানে ধস নামছিলো মাঝেমধ্যেই বন্ধ করে দিচ্ছিল প্রশাসন। অনেক গাছ এবং বেশ কিছু কাঁচা বাড়ি দেখতে গেলাম মাটি থেকে উপড়ে গেছে। এই সব ভয়াবহ সব ছবি দেখতে দেখতে সন্ধেবেলা আমরা দার্জিলিং গিয়ে পৌঁছলাম। তারপর২০, ২১ আর ২২ অক্টোবর দার্জিলিং-এ Hotel Dekeling-এ থেকে, সেখান থেকে আর এক প্রস্থ মন ভোলানো সূর্যাস্ত দেখে অবশেষে ২৩অক্টোবর ট্রেন ধরে ২৪ তারিখ কলকাতা ফেরা হলো। সত্যি বলতে নর্থ সিকিমের এতো সুন্দর একটা ট্রেক শেষ করে, এতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে পড়েও, ট্রেন ক্যানসেল করে তিন রাত্তির দার্জিলিংয়ে থাকার সুযোগ মেলাটা মনে হয় ওই ট্রিপের উপরি পাওনা ছিল।