পলাশের টানে পুরুলিয়ার দুয়ারসিনিতে একবার মার্চের এক প্রায়-অপরাহ্নে উপস্থিত হলাম। সেদিন সাতসকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ৬.৩৫-এর ইস্পাত ধরে ঘাটশিলায় পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় বেলা ৯.৩৫ বেজে গিয়েছিল। ধলভূমগড় স্টেশন পেরিয়ে যাওয়ার পর ট্রেন থেকেই পলাশফুল পরিদৃশ্যমান হতে শুরু করেছিল। পলাশের স্বাগত সম্ভাষণে যথারীতি আমাদের চিত্ত উৎফুল্ল। ঘাটশিলায় নেমে আগে থেকে ঠিক করে রাখা দীপক সেনের টোটো করে প্রথমেই চলে গেলাম রামকৃষ্ণ মঠে। চমৎকার মানুষ এই দীপক সেন। চরম দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে বড় হয়েছেন। নিজের সেই লড়াইয়ের দিনগুলি তিনি বিস্মৃত হন নি। তাই গ্রামের অসহায় দীনদরিদ্র আদিবাসীদের জন্য তাঁর সাহায্যের হাত তিনি সব সময়ে প্রসারিত করে রেখেছেন। বছরে দু-তিনবার তিনি তাঁদের নিজের হাতে রান্না করা মাংস-ভাত খাওয়ান। আবার কলকাতা থেকে গালুডি বা দুয়ারসিনিতে ঘুরতে এসে যাঁরা দীপকের টোটোতে করে ঘোরাঘুরি করেন --তাঁদের সহায়তায় এবং উপস্হিতিতে দীপক দরিদ্র আদিবাসীদের মধ্যে বস্ত্র, কম্বল, গরম পোষাক বিতরণ করে আনন্দে থাকেন। আজকের অবক্ষয়ের যুগে এরকম শ্রদ্ধার যোগ্য কিছু মানুষ আছেন বলেই পৃথিবীর ভারসাম্য বজায় রয়েছে।
রামকৃষ্ণ মঠ থেকে গেলাম আমাদের কাছে তীর্থক্ষেত্র-সদৃশ স্হান—প্রকৃতিপ্রেমিক সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বসতবাড়ি। যতবার ঘাটশিলা এসেছি, প্রত্যেকবার এখানে উপস্থিত হয়ে, পথের পাঁচালী-র অপুর মতো অপার বিস্ময়ে লেখককে বোঝার চেষ্টা করেছি। লেখকের বর্ণিত সহজ সরল গ্রাম্য জীবন আজও আমাদের কাছে সমান আকর্ষণীয়। তাঁর নিসর্গ-প্রীতি দেখেই আমাদের প্রকৃতিপ্রেমের বর্ণপরিচয় হয়েছে।
অতঃপর গালুডির কিছু দ্রষ্টব্য দেখে আমরা দুয়ারসিনিতে এসে উপস্থিত হলাম। দুয়ারসিনি কথাটির বাংলা অর্থ দ্বাররক্ষক ঠাকুর। কেউ কেউ মনে করেন, দুয়ারসিনির 'আসিনি' শব্দের মাধ্যমে সিদ্ধা রমণী বোঝানো হয়েছে। বৌদ্ধমতে সিদ্ধা রমণীরা অলৌকিক শক্তিসম্পন্না ছিলেন। মৃত্যুর পর তাঁদের পুজো করা হত। পরবর্তী কালে 'আসিনি' শব্দ পরিবর্তিত হয়ে 'সিনি' শব্দে রূপান্তরিত হয়। অদ্যাপি শক্তিরূপিণী 'সিনি'দেবী-ই গ্রামের দেবী হিসেবে পূজ্যমান।
আমরা দিন তিনেক পশ্চিমবঙ্গ বন উন্নয়ন নিগমের দুয়ারসিনি প্রকৃতি ভ্রমণকেন্দ্রের আবাসস্থলে ছিলাম। বনবিভাগের সেই বাংলোর অবস্থান একেবারে প্রকৃতির কোলে। সামনে ছোট ছোট পাহাড়, পাহাড়ের গায়ে বৃক্ষের বাহার। শাল, পিয়াল, শিমূল, পলাশ, বহেরা গাছের জঙ্গল। যেদিকে তাকাই, শুধু গাছ আর গাছ-- দৃষ্টিনন্দন সেই রূপ। কাছাকাছি কোনও জনবসতিও নেই। সারা দিনরাত অখণ্ড নিস্তব্ধতা বিরাজ করে। দিনের বেলা কান পাতলে শুধু চেনা অচেনা নানারকম পাখির কলকাকলি শোনা যায়-- শ্রুতিমধুর সেই রবে মন মুগ্ধ হয়। এমত পরিবেশে--এই নিরালায়, নির্জনতায় প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় সখ্য গড়ে ওঠে। বসন্তকালে আবার বাংলোর বারান্দায় বসে থাকলে, মহুয়ার মদির করা সুবাসে মন মাতাল হওয়ার উপক্রম। শহরের কোলাহল বর্জিত উন্মুক্ত প্রকৃতির মাঝে,Thomas Hardy -র ভাষায় 'Far from the madding crowd'-এ তিনদিন অতিবাহিত করে অনন্য এক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করলাম। এই আবাসনের বেশিরভাগ কর্মী স্হানীয় আদিবাসী। এখানে মূলতঃ সাঁওতাল, মুন্ডা,শবর ইত্যাদি গোষ্ঠীর মানুষজন বসবাস করেন।
বহু জনতার কোলাহল আমাদের একেবারেই পছন্দ নয়। আমরা মোটামুটি নির্জনতাপ্রিয় মানুষ। তাই বসন্তের দোল উৎসবের শেষে, পলাশের প্রায় বিদায় লগ্নে আমরা পলাশের দেশ পুরুলিয়ায় এসেছি। লোকমুখে শুনেছি, এবছর বিস্তর পলাশ ফুটেছে। পলাশের সেই প্রাচুর্যের কারণে আমরা এই অন্তিম লগ্নেও দেদার পলাশ দেখে বিমোহিত। সত্যি সত্যিই মনে হচ্ছিল "নীল দিগন্তে ওই ফুলের আগুন লাগল/বসন্তে সৌরভের শিখা জাগল।" সকাল আর সন্ধ্যাতে মনোরম আবহাওয়া। সারা দিনমান রোদের তাপে সমগ্র অঞ্চল তেতেপুড়ে একাকার। সেই দাবদাহের আঁচে আমরাও নাজেহাল হয়েছি। কিন্তু বিস্তীর্ন এলাকা জুড়ে শুধু পলাশ আর পলাশ দেখে, সেই সৌন্দর্যে এমনই আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম যে মনে হচ্ছিল--এহো বাহ্য।
পলাশ ফুলের সঙ্গে এবার আমরা এখানে 'কুসুম' গাছও দেখলাম। এই গাছের বেশ কিছু পাতার রঙ লাল। শুনেছি, যখন নবপত্রের সঞ্চার হয়, কেবলমাত্র তখনই সেই পাতার রঙ হয় টকটকে লাল। মনে হয় যেন লাল রঙের কোনও ফুল। কিছুদিন গাছে থেকে তারপর সেই পাতা হলদে সবুজ এবং পরে গাঢ় সবুজ বর্ণের হয়ে যায়। বসন্তকালেই শুধু এই গাছের এবংবিধ রূপ দেখা যায়। তখন দারুণ সুন্দর দেখতে লাগে সেই কুসুম গাছ! আগে গ্রামে গঞ্জে বনবাদাড়ে গরমকালে প্রচুর কুসুম ফল পাওয়া যেত। কিন্তু বর্তমানে কুসুম ফল লালমাটির লুপ্তপ্রায় অরণ্যসম্পদ। এই গাছ আমি গতবছর ইংল্যান্ডের বার্মিংহামে দেখেছিলাম এবং বিস্ময়াভিভূত হয়েছিলাম। পুরুলিয়ায় আসার আগে এক বন্ধু সঙ্ঘমিত্রা ঘোষের কাছে কুসুম গাছের কথা শুনেছিলাম। তখনও বুঝতে পারিনি, বিদেশে আমরা ইতিপূর্বে এরকম যে গাছের দেখা পেয়েছিলাম --সেই গাছই আমাদের দেশে কুসুম গাছ নামে পরিচিত। জীবনের চলার পথের প্রায় প্রতিটি বাঁকে এরকম কতশত বিস্ময় যে আমাদের জন্য অপেক্ষা করে থাকে!