নীল নদকে চোখে চেয়ে দেখাই ছিল ছোটবেলার স্বপ্ন, আর তার বুকে তিনটি রাত আর পুরো দুটো দিন ভেসে বেড়ানো হল স্বপ্নপূরণের চেয়ে অনেক বেশি। যে ছবি ছিল এতদিন কল্পনায়, বাস্তবে তা দেখলাম আরো বিশাল, আরো সুন্দর। পৃথিবীর দীর্ঘতম নদী নাইল, দক্ষিণ থেকে উত্তরে বয়ে যাওয়া এগারোটি দেশ অতিক্রম করা একমাত্র নদী, তার সবচেয়ে বেশি অংশ মিশরে। হাজার হাজার বছর ধরে হাজার হাজার কিলোমিটার মানুষ আর পণ্য পরিবহনের প্রধান মাধ্যম এই নদী। আসওয়ান হাই ড্যাম তৈরি করার পর নদীর জলস্তরের পরিবর্তন হয়, আসওয়ান থেকে ভূমধ্যসাগরে নীল নদের মোহানা পযন্ত অনেক বাঁধ নির্মাণের ফলে এখন পুরো নদী পথ ক্রুজ বা বোটে চেপে ঘোরা যায় না। সবচেয়ে প্রচলিত অংশটি হল আসওয়ান থেকে লাক্সর পযন্ত দুশো আশি কিলোমিটার নদী পথ।
কায়রো থেকে ট্রেনে চেপে আসওয়ান পৌঁছানো যায়, সময় বাঁচাবার জন্য আমি পৌঁছলাম আকাশ পথে। এয়ারপোর্টে যখন নামলাম তখন সন্ধ্যা নেমে গেছে, জানুয়ারির মিশরে কনকনে ঠান্ডা, আধ ঘণ্টায় পৌঁছে গেলাম একদম নীল নদের ধারে। ক্রুজের জাহাজটি পাড়ে দাঁড়িয়ে ছিল। নাম তার কোনটিকি। এরকম আরো অনেক ছোট বড় জাহাজ দাঁড়িয়ে, পেছনে পেছনে, পাশাপাশি তিন চারটি। আসওয়ান শহরের যে অংশ নদীর পাড় বরাবর, সেখানে লম্বা রাস্তা, এক দিকে নদী, তার উপর ভেসে থাকা জাহাজের অসংখ্য ঝিকিমিকি আলো, আর অন্য দিকে রকমারি দোকান হোটেল রেস্টুরেন্ট, সারা পৃথিবীর টুরিস্টদের ভিড়। এখানে দেখা পেলাম নুবিয়ান মানুষদের। মিশরের দক্ষিণ আর সুদানের উত্তর অংশ জুড়ে নুবিয়ান এলাকা, সুদানিজ আর মিশরীয় আরব মানুষের চেয়ে এরা দেখতে বেশ অন্যরকম, সভ্যতা সংস্কৃতিও আলাদা। নুবিয়ানদের সঙ্গে প্রাচীন মিশরের যোগাযোগ অনেক পুরানো, বিখ্যাত ফারাও দ্বিতীয় রামেসিসের এক নুবিয়ান স্ত্রী ছিল, দুজনের একসাথে মূর্তি লাক্সরে আছে। কাল সকালে পাল তোলা নৌকা ফেলুকা চড়িয়ে নুবিয়ান গ্রাম ঘুরিয়ে আনার জন্য টুরিসটদের ধরাধরি আর দরাদরি চলছে। ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই, কাল খুব ভোরে উঠে ২৮৮ কিলোমিটার দুরে আবু সিম্বেল ঘুরে আসতে হবে, তাই শিগগির ঢুকে পড়লাম ক্রুজের ভিতরে।
চার তলা জাহাজের অন্দরে ঢুকলে মনে হয় ফাইভ স্টার হোটেল, জানালা দিয়ে বাইরে না তাকালে জাহাজ বলে বোঝা যায় না। একদম নীচে ডাইনিং হলে খাবারদাবারের এলাহী আয়োজন। ছাদে সুইমিং পুল, চা কফির কাপে চুমুক দিয়ে নদীর দু পার শুয়ে বসে দেখার ব্যবস্থা। আর আছে প্রত্যেক তলায় বিশাল লাউঞ্জ, বার, রকমারি জিনিসপত্রের দোকান। রাতের ঠান্ডায় ছাদে উঠে আসওয়ানের নীল নদের এক ঝলক দেখে নীচে নেমে ডিনার সেরে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম। পরের দিন দুপুরের পর ক্রুজ চলা শুরু হল। লাঞ্চের পর গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে ছাদে চলে গেলাম। জানুয়ারির দুপুরেও খুব ঠান্ডা, জোরালো হাওয়া গায়ে ছুরির মত বিধছে। কিন্তু নদীর দুই পাড়ের সৌন্দর্য দু চোখ ভরে উপভোগ করার আনন্দে বাকি সব কিছু ভুলে যেতে হয়।
আসোয়ানে নদীর দুপারেই হলুদ বালিয়াড়ির পিছনে বিস্তীর্ন মরুভূমি। গুগল ম্যাপে দেখা যায় মরুভূমির বিস্তীর্ন হলুদ বালির মধ্যে নদীর নীল সরু রেখা, আর সেই নীলের পাশে সবুজের কম বেশি বর্ডার, সেগুলোই শস্য ক্ষেত, ফল ফুলের বাগান। একটু পরে শুরু হল সেই সবুজ। গমের ক্ষেত, আখের ক্ষেত, আম বাগান। এতদিনে আমার সত্যিকারের মনে হল কেন গ্রিক দার্শনিক হেরোডোটাস বলেছিলেন মিশর দেশটি নীল নদের দান। একটু লক্ষ্য করে দেখলাম, দশ বারো ঘর নিয়ে ছোট ছোট গ্রাম আর মাঝে মধ্যে অনেক ঘর বাড়ি নিয়ে ছোট শহর বা গনজ, সবই একেবারে নদীর পাড় ঘেঁষে। মানুষজনের চলাফেরা, নিত্য দিনের কাজকর্ম সব চোখে পড়ছে। শহরগুলোর নদীর পাড় ইট কংক্রিট দিয়ে বাঁধানো। অনেক সিঁড়ি নদীর জলে নেমেছে। সিঁড়িগুলি পাথর আর কাঠ দিয়ে বাঁধা। নীল নদের জলেই সে গ্রামের মানুষের বোধ হয় সব কাজ সারা হয়, স্নান করা, থালা বাসন ধোয়া, কাপড় কাচা, গোরু বাছুরকে খাওয়ানো। পুরুষ মহিলা বাচ্চা কাচ্চা কত রকমের মানুষ দেখে দেখে কী ভাবে যে সময় কেটে যায় বোঝা যায় না। বয়স্ক মানুষেরা বসে আড্ডা মারছে, ছোট ছেলেরা ফুটবল খেলছে, ক্ষেত খামারে কাজ করছে মানুষজন। গ্রামগঞ্জ একদম নদীর ধারে, বাঁধানো সিঁড়ি জলে নেমেছে, সেখানে বাঁধা ছোট্ট নৌকা, বোধ করি ওপারে যাবার জন্য। এক ঘাটের উপর দেখলাম ব্যাগ গুছিয়ে বোরখা পরা নারী অপেক্ষা করছে খেয়া নৌকার জন্য, সঙ্গে তার ছোট্ট দুটো মেয়ে, সুন্দর সাজগোজ, নিশ্চয়ই ওপারে তাদের মামা বাড়ি।
নদীর পাড় ধরে চওড়া রাস্তা, কোথাও ভাঙা পিচের, কোথাও ধুলো ওড়ানো মাটির। সব গ্রামে দেখলাম পোষা গাধার চল, চাষের কাজে লাগছে, বস্তা পিঠে চাপিয়ে মালপত্র বইছে, আর অনেক মানুষ গাধার পিঠে চেপে ধীর গতিতে চলছে, সে এক দেখার মতো দৃশ্য। ছোট শহর বা গঞ্জগুলো বেশ ঘিঞ্জি, সরু রাস্তা আর অলিতে গলিতে চলছে হলুদ কালো রংয়ের অটো, এবং সবই আমাদের দেশের বাজাজ কোম্পানির, দেখে ভালো লাগে। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল যদি ওই অটো চেপে দুরের গ্রামে চলে যেতে পারতাম, কিন্তু তা তো এযাত্রায় সম্ভব নয়। গ্রামের মানুষের পোষাক পরিচ্ছদও দেখার মতো, পুরুষের ছোট বড় সবার ফুল হাতা সাদা ঝোলা পাঞ্জাবীর মত, মেয়েদের মাথায় হিজাব, কারো কালো বোরখা। বাচ্চা ছেলেমেয়েরা মুখে হাসি নিয়ে ক্রুজ বোটের পর্যটকদের হাত নাড়ছে, মনে হল এটা তাদের প্রতিদিনের রুটিন দায়িত্ব। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামল, নীল নদের উপর সূর্যাস্ত, চেয়ে চেয়ে দেখলাম।
ঠিক সন্ধ্যার পর ক্রুজ পৌছাল কমোমবো মন্দিরের কাছে। নদীর উপর থেকেই দেখা যায় দু হাজার বছরের বেশি আগের বিশাল সৃষ্টিকে, ফারাও আর পরবর্তী গ্রিক স্থাপত্যের অসাধারণ নিদর্শন। দু ঘন্টায় কমমবো দর্শন সেরে ক্রুজে ফিরে ডিনার সারতে গেলাম। ডিনারের মধ্যে মজার ঘটনা ঘটল। আরবি বাদ্যযন্ত্র আর আরবি গান গাইতে গাইতে ক্রুজ কর্মীরা আমাদের সবাইকে নিয়ে এক ছোট পর্যটকের বার্থ ডে সেলিব্রেট করলেন। ক্রুজে ওঠার সময় পাসপোর্ট জমা রাখতে হয়, সম্ভবত সেখান থেকেই বিশেষ তারিখটা জানা যায়।
পরের দিন খুব ভোরে উঠেই নদীর ডানদিকের পাড়ে বিখ্যাত মন্দির এডফু দর্শন। ফারাও তৃতীয় তুতমোস-এর আমলে প্রতিষ্ঠিত, খ্রিস্টের জন্মের তিনশো পঞ্চাশ বছর আগের অতি বিশাল স্থাপত্য। আগে একদম নদীর ধারে ছিল, এখন নদী দূরে সরে গেছে, ঘোড়ার গাড়ি চড়ে ঘুরে এলাম। ব্রেকফাস্ট সেরে আবার ছাদে উঠে এলাম। সামনে পিছনে অনেক ক্রুজ লাইন ধরে চলছে, উল্টো পথের জাহাজগুলো পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এক ক্রুজ কর্মী জানালেন এরকম তিনশো জাহাজ প্রতি দিন লাক্সর আর আসওয়ানের মাঝে চলাচল করছে। কিছু পাল তোলা ছোট বোট দেখলাম, যেগুলো ফেলুকা নামে বিখ্যাত, সেগুলো আগে দাঁড় টানা ছিল, এখন সব মোটর বোট, প্রমোদ ভ্রমণের তরনী। ধনী পর্যটকরা এরকম লাক্সারি ফেলুকায় সাত আট দিন ধরে নদীর উপর ভেসে বেড়ান।
পাখিপ্রেমীদের জন্য নীল নদের এই সফর এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা হতে পারে। অনেক জায়গায় চওড়া নদীর বুকে ছোট ছোট সবুজ দ্বীপ, সেখানে পাখির মেলা। ইগ্রেট, হেরন, করমোরানট, ডাক। জলের উপর ভেসে বেড়ায় পেলিক্যানের দল। তীরে গাছের ডালে বসে কিং ফিশার আর ঈগল। দুপুরে এসে পৌঁছলাম এসনা লকে। হাই ড্যাম নির্মাণ করার ফলে নদীর জলস্তরের এমন পরিবর্তন ঘটে যে কিছু জায়গায় জাহাজের পথ রুদ্ধ হয়, লক নির্মান
করে জলস্তর বাড়িয়ে পথ তৈরি করা হয়েছে। এসনা দেখলাম বেশ ঘিঞ্জি শহর, বাড়িঘর দোকানপাট বাজারঘাট সব একদম নদীর ধারে। দু দিন ধরে দেখেছি নদীর দু পারে অনেক মসজিদ, ছোট বড়, কারো সুউচ্চ মিনার, কারো বিশাল গম্বুজ। নদীর উপর মাছ ধরা দেখতেও বেশ লাগে। কেউ ডিঙি নৌকায় নাইলনের জাল ফেলে আর কেউ পাড়ে বসে ছিপ ফেলে মাছ ধরছে। আর এক অবাক করা ব্যাপার দেখলাম নদীর উপর স্থানীয় মানুষজনের ব্যবসা বাণিজ্য। ছোট্ট স্পিড বোট চেপে এসে ক্রুজের গায়ে লাগিয়ে উপরে জিনিসপত্র ছুঁড়ে দেয়, সস্তার শাল কম্বল। ক্রেতার পছন্দ হলে সেই প্লাস্টিক প্যাকেটের মধ্যে টাকা রেখে নীচে ফেলে দিতে হয়।
এত কিছু দেখতে দেখতে আকাশ লাল করে সূর্য ডুবল, নীল নদের উপর এবারের মতো শেষ সন্ধ্যা। ক্রুজ এসে পৌঁছে গেল লাক্সর। নদীর উপর থেকেই দেখা যায় আলো ঝলমল বিখ্যাত লাক্সর টেম্পল। কাল সারাদিন ধরে নদীর এপার ওপার ছুটে দেখতে হবে ঐ মন্দির, অতি বিশাল কারনাক মন্দির, ভ্যালি অব কিংস, ভ্যালি অব কুইন্স। ক্রুজের শেষ রাত গালা ডিনারের সাথে অ্যারাবিয়ান ড্যান্স আর বেলি ড্যান্স, চাক্ষুষ না করলে বিশ্বাস হয় না।