সন্ত কবীর লিখেছিলেন, “বহতা পানি নির্মলা, বন্ধা গন্ধিলা হোয়।” বহতা নদীর জলধারায় স্বচ্ছ নির্মল থাকে, বদ্ধ জলাশয় হয়ে যায় অস্বচ্ছ আবিলতাপূর্ণ। এসব কথা তো জীবন থেকেই নেওয়া। কবীরের দোঁহা-র এই সারাৎসারটুকু আমাদের জীবনেও আলো ফেলে। প্রতিদিনের জীবনযাপনের একঘেয়েমি, চাওয়া-পাওয়া, সাফল্য-ব্যর্থতার হিসেব-নিকেশে মন যখন হাঁপিয়ে ওঠে, তখনই সেই সব ক্লান্তি, আবিলতার ভার নামাতে মন বলে ওঠে চলো বেরিয়ে পড়ি। "হেথা নয় হেথা নয় অন্য কোথা অন্য কোনখানে।" আমাদের কলেজ-ইউনিভারসিটির বন্ধুবান্ধবীদের একটি পুরনো দল আছে। এদের মধ্যে দুই জোড়া একসাথে পর্যটন করতে করতে সুখী দম্পতি। এরা আমাকেও ভ্রমণ সঙ্গী করে নেন। দেশে-বিদেশে বহুবার বহু জায়গায় আমরা একসাথে ভ্রমণ করেছি। এবারে ঠিক হলো চলো নাগাল্যান্ড যাই। সামনেই সেখানকার বিখ্যাত হর্নবিল উৎসব, এই উৎসবে যোগদানকে মুখ্য করে হবে আমাদের নাগাল্যান্ড পরিভ্রমণ।
যোগাযোগ করা হলো কলকাতার নাগাল্যান্ড ভবনে। সেখান থেকে নাগাল্যান্ড সরকারের ডিপার্টমেন্ট অফ আর্ট এন্ড কালচার, সেখান থেকেই কোহিমার এক ভ্রমণ সংস্থা আমাদের হর্নবিল উৎসব সহ নাগাল্যান্ড পরিভ্রমণের সব ব্যবস্থা করে দেবেন। নাগাল্যান্ড প্রবেশের জন্য ইনারলাইন পারমিট করা হলো আন্তর্জাল বা ইন্টারনেটের মাধ্যমে খুব সহজেই। ভ্রমণসূচি স্থির করা থাকা-খাওয়া আমাদের মত একদল বরিষ্ঠ নাগরিকদের দেখভাল করার সমস্ত দায়িত্ব নিয়ে নিলেন সেই পর্যটন সংস্থাটি। আমার বন্ধু দলপতি কলকাতায় বসে ওদের সঙ্গে কথা বলে সব ব্যবস্থা করে ফেললেন। হর্নবিল উৎসবে খুব ভিড় হয়, দেশ-বিদেশ থেকে প্রচুর লোকজন আসেন নাগাল্যান্ডে। এই উৎসবকে নাগাল্যান্ডের জাতীয় উৎসব বলা যায়। আমাদের দলের সব সদস্যরাই কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলিতে থাকেন, আমি উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়িতে। পুরনো বন্ধুত্ব এবং পর্যটন সূত্রে আমরা মাঝে মাঝেই পরস্পরের কাছাকাছি আসি, পুরনো সেই সব দিনের টানে সুখেরদুঃখের কথা কই। দিনক্ষণ স্থির হয়ে গেল ৫ই ডিসেম্বর থেকে ১২ই ডিসেম্বর পর্যন্ত আমরা নাগাল্যান্ডে থাকবো। হর্নবিল উৎসব পয়লা ডিসেম্বর থেকে ১০ই ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে। নাগাল্যান্ডের অন্যান্য স্থানগুলি ভ্রমণ করতে করতে আমরা নাগাল্যান্ডের রাজধানী কোহিমায় পৌঁছে যাব হর্নবিল উৎসব চলাকালীন সময়ে।

আমাদের সবার কাছে নাগাল্যান্ড পরিভ্রমণের অনুমতি পত্র এসে গেল। সেখানে আমরা কবে কোথায় থাকবো, সব স্থির করা আছে। ৪ ডিসেম্বর ২০২২ হাওড়া থেকে গৌহাটিগামী একটি ট্রেনে যাত্রা শুরু হল। আমি ওই ট্রেনে উঠলাম জলপাইগুড়ি রোড স্টেশন থেকে একই কামরায় সবাই একটু ছড়িয়ে ছিটিয়ে। হই হই করে আড্ডায় জমে গেলাম। রাত গভীর হচ্ছে, ভোরবেলায় গৌহাটি পৌঁছে যাব। গৌহাটিতে ট্রেন ভোর সাড়ে ছটা নাগাদ পৌঁছল। আমাদের পরবর্তী যাত্রার ট্রেন ওই গৌহাটি স্টেশন থেকেই দুপুর ১টায়। হাতে অনেকটাই সময় আছে ভেবে লকরুমে মালপত্র জমা রেখে সবাই বেরিয়ে পড়লাম। ঠিক করা হলো ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে গিয়ে প্রাতঃভ্রমণ করে প্রাতরাশ করা হবে।
গৌহাটি স্টেশন থেকে বেরিয়ে কাছারি রোডে এসে অটো ধরে ব্রহ্মপুত্রের শুক্রেশ্বর ঘাটে চলে এলাম। এই ঘাটের সাথে লাগোয়া সুদৃশ্য একটি উদ্যান আছে। সেখানে রয়েছে মোগলদের সাথে আসাম রাজের যুদ্ধের স্মারক স্তম্ভ। বেশিক্ষণ থাকা হলো না পরবর্তী ট্রেন ধরার প্রস্তুতি নিতে হবে। আমাদের সেই ট্রেনটি এলো নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে বেশ কয়েক ঘণ্টা দেরিতে চলছে ট্রেনটি আসছে সেই সুদূর কন্যাকুমারিকা থেকে। আমাদের গন্তব্য শিমালগুড়ি নামে একটি স্থান, ওই শিমালগুড়ির নামেই রেলওয়ে স্টেশনে আমাদের নামতে হবে। রাতে থাকার বন্দোবস্ত ওই শিমালগুড়ি স্টেশনের কাছেই একটি হোটেলে। ট্রেনটি লেট থাকার দরুন আমাদের শিমালগুড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে অনেক রাত হয়ে গেল। তবে পর্যটন সংস্থার ব্যবস্থাপনায় সেই হোটেল কর্মচারীদের সহযোগিতায় আমাদের থাকা এবং খাবারের কোনও অসুবিধে হলো না।

শিমালগুড়ি লামডিং-ডিব্রুগড় সেকশনের ছোট্ট রেলওয়ে স্টেশন। আসামের শিবসাগর জেলার একটি ঝকঝকে ছোট্ট শহর। ভোর হতেই হোটেলের সামনের রাস্তায় একটু বেরিয়ে নিলাম। ঝকঝকে রোদ উঠেছে, দূরে পাহাড়ি পথের হাতছানি। চারপাশটা আমাদের ডুয়ার্সের চা বাগান কেন্দ্রিক উপশহরের মতো। আসবার সময় নাগাল্যান্ডের ষ্টেশন ডিমাপুর পার হয়ে এসেছি। নাগাল্যান্ড ভ্রমণ শেষ করে আমরা ফিরব ডিমাপুর স্টেশন থেকে কিন্তু আমাদের যাত্রা শুরু হবে শিমালগুড়ি থেকে নাগাল্যান্ড অভিমুখে। আমাদের পর্যটন সংস্থা এভাবেই ভ্রমণসূচী স্থির করেছিলেন। সকাল সাড়ে নটা নাগাদ নয় সিটের ট্রাভেলার গাড়ি নিয়ে এলেন ভ্রমণ সংস্থা থেকে আমাদের ভ্রমণ নির্দেশক মিস্টার এপ্রিল, ২৫-২৬ বছরের নাগা যুবক। বেশ হাসিখুশি ছেলেটি, ঝরঝরে ইংরেজি আর অল্পস্বল্প হিন্দি বলতে পারে। আলাপ পর্ব শেষ হবার পর ও নিজেই বলল নাগাদের অন্যতম জনজাতি কোনিয়াক সম্প্রদায়ের সে। ড্রাইভার ছেলেটিও ওর বয়সী, আসামের ছেলে, বাংলা বোঝে, একটু অসমিয়া টানে ভালো বাংলাও বলতে পারে। দুটি ছেলেই অত্যন্ত আন্তরিক, আমাদের খুবই ভালো লেগে গেল ছেলেদুটিকে। আমাদের গাইড মিস্টার এপ্রিল জানালেন, আমাদের ভ্রমণসূচিতে আছে প্রথমে আমরা প্রবেশ করব নাগাল্যান্ডের জেলা শহর 'মন'এ। সেখান থেকে আরেকটি জেলা শহর মককচুঙ। সেখান থেকে কোহিমা। আমাদের থাকবার বন্দোবস্ত হয়েছে কোহিমা থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে যেখানে হর্নবিল উৎসব হয় সেই কিসামা ভিলেজ-এর কাছে একটি হোমস্টে-তে। অতঃপর শিমালগুড়ি থেকে আমাদের যাত্রা শুরু হলো নাগাল্যান্ডের মন শহরের অভিমুখে।
শিমালগুড়ি থেকে আসামের শিবসাগর জেলার ভেতর দিয়ে নাগাল্যান্ডের মন শহরে ঢুকতে হয়। যাবার পথে শিবসাগর জেলায় বেশ কয়েকটি চা বাগান দেখলাম। দোকানপাট বাজারে বাংলায় সাইনবোর্ড ও কয়েকটি জায়গায় দেখেছি, এখানে বাঙ্গালীদেরও বসতি রয়েছে। বেলা তিনটে নাগাদ নাগাল্যান্ডের জেলা শহর মন-এ পৌছালাম। মন নাগাল্যান্ডের সবচেয়ে উত্তরের জেলা। এর উত্তরে অরুণাচল প্রদেশ পশ্চিমে আসাম, পূর্বে মায়ানমার। মন শহরটি জেলার সদর। মন শহরটিকে পাহাড়ের পাদদেশে বলা যায়, পাহাড়ি পথ বেয়ে একটু উপরে একটা রিসর্টে দুদিন আমাদের থাকবার বন্দোবস্ত হয়েছে। রিসর্টটির নাম হিলটপ রিসর্ট। এই রিসর্ট-এ দুজন করে থাকবার মতো একাধিক কটেজ রয়েছে। কটেজগুলি নাগাল্যান্ডের নিজস্ব গৃহনির্মাণশৈলিতে তৈরি, বাঁশ কাঠ আর টিনের ছাউনি দিয়ে। খুব সুন্দর করে কটেজগুলি সাজানো নাগাল্যান্ডের ঐতিহ্যশালী তাঁতে বোনা চাদর, শাল বাঁশ দিয়ে তৈরি ঘর সাজানোর নানা উপকরণ দিয়ে। কটেজের সামনে ফুলবাগান সেখানে বসবার বেতের চেয়ারে বসে রোদ পোহানো, কটেজের পেছনে ব্যালকনি যেখানে বসে নীচের উপত্যকা, পাহাড়ি ঝোরা, জঙ্গল বেশ দেখা যায়। পাহাড়ে ঘেরা উপত্যকার মতো জায়গাটা। থাকা ও খাওয়ার অত্যন্ত সুবন্দোবস্তু।

কিচেনে বসে আমাদের জন্য নির্ধারিত মেনুর সাথে দুই একটি অতিরিক্ত নাগা ব্যঞ্জনেরও স্বাদ নিলাম, মন্দ লাগেনি। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ চলছিল, বড়দিন কাছে। শহরে বেশ বড় বড় কয়েকটি চার্চ রয়েছে। আসবার সময় দেখছিলাম রাস্তার দু'পাশ জুড়ে আলোকমালা সাজানোর প্রস্তুতি। ক্রিসমাস ট্রি, প্রভু যীশুর নানান চিত্র। সন্ধ্যা নামার আগেই আমাদের গাইড মিস্টার এপ্রিল কাছে পিঠে ঘুরিয়ে নিয়ে এলো, একটি বড় চার্চে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে শহরের রাস্তায় একটু ঘোরাঘুরি করে আবার রিসর্টে। এপ্রিল জানিয়ে দিলেন নৈশাহারের সময় পরদিন সকাল ন'টায় মন শহর থেকে ৪১ কিলোমিটার দূরে নাগা উপজাতিদের একটি ঐতিহ্যশালী গ্রাম লুংওয়া (Lungwa village) নিয়ে যাবে।
পরদিন সকালেই ব্রেকফাস্ট সেরে লুংওয়া গ্রামে যাবার উদ্যোগ শুরু হল। শহর ছাড়িয়ে গ্রাম। এই লুংওয়া গ্রামটি মন জেলার বৃহত্তম গ্রামগুলির মধ্যে একটি। এটি ভারত ও মায়ানমার সীমান্তে অবস্থিত। গ্রামের একটি দিক ভারতের অপরপ্রান্তটি মায়ানমারের। জানতে পারলাম এই গ্রামের অধিবাসীরা ভারত ও মায়ানমারের নাগরিকত্ব পেতে পারেন। এক দেশ থেকে আরেক দেশে যেতে ভিসা লাগে না। সীমান্ত পেরিয়ে অবাধে যাতায়াত করতে পারেন। গ্রামের প্রধান হলে অঙ্গ বা রাজা, ৭০টির বেশি গ্রামের রাজপাট তিনি সামলান। ছবির মত সুন্দর গ্রাম কোন চিত্রকরের তুলি দিয়ে আঁকা। এখানকার মানুষেরা নিজেদের সংস্কৃতি সংরক্ষণ করে রেখেছেন। গ্রামের প্রধান বা অঙ্গের প্রাসাদের মধ্য দিয়েই গিয়েছে আন্তর্জাতিক সীমানা। তিনি যে ঘরে খান সেটি ভারতের আর যে ঘরে ঘুমান সেটি মায়ানমারের। এই গ্রাম প্রধানের সাথে দেখা করবার ইচ্ছা প্রকাশ করলে জানা গেল তিনি মাছ ধরতে গেছেন, তবে তাঁর রাণী রাজপ্রাসাদেই আছেন। তাঁর সাথে দেখা করবার অনুমতি মিলল। আমাদের সাথের মহিলারা রাণীর সাথে ছবি তুললেন, রাণীর রান্নাঘরে ঢুকলেন, সেখানে রাণী রান্না করছিলেন। তাঁদের নিজস্ব আসবাবপত্র সাজিয়ে রাখা হয়েছে।
এসব দেখে বিভূতিভূষণের আরণ্যকের কথা খুব মনে পড়ছিল সেই রাজা দোবরু পান্না ও ভানুমতির কথা, ভারতবর্ষ কোন দিকে? এই গ্রামে প্রচুর আনারস পেঁপে ফলে, বাঁশঝাড়ও প্রচুর, নানা প্রজাতির বাঁশ। এলাকার বেশিরভাগ মানুষই কৃষিজীবী, রাস্তায় টুরিস্টদের আগমনের অপেক্ষায় গ্রামবাসীরা বসে আছেন আনারস পেপে কলার পসরা সাজিয়ে, বেশিরভাগই গ্রামের মহিলারা। সেসব কিনে ফলাহার করা হলো। এই গ্রামের মানুষেরা খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ। গ্রামের লোকেরা কনিয়াক উপজাতি অন্তর্গত অতীতে যারা হেড হান্টার হিসেবেও পরিচিত ছিলেন এপ্রিল জানালেন ১৯৬০-এর দশকেও এই গ্রামে হেড হান্টিং একটি জনপ্রিয় ক্রীড়া অনুশীলন ছিল। এই গ্রামের অনেক পরিবারে পেতলের খুলির মালা রয়েছে। যুদ্ধে একপক্ষ অপরপক্ষকে জয় করে সেই বিজয়ের প্রতীক হিসেবে রেখে দেয় এই ধরনের টোটেমকে। গ্রামের নিকটবর্তী মায়ানমার সীমান্ত আফিম পাচারের জন্য বিখ্যাত, তবে এই গ্রামে আফিম চাষ করতে দেওয়া হয় না।

সারা গ্রাম ঘুরে আবার ফিরে এলাম মন শহরের রিসর্টে সেখানে মধ্যাহ্নভোজ সারতে। বিকেলের দিকে আরেকটি নাগা গ্রামে গেলাম। এই গ্রামটির নাম লেঙ্গা (Lengha village)। ২২৪টি পরিবারের বসবাস। এখানে সবাই কৃষিজীবী, ধান চাষ হয় গ্রামের একাধিক বাড়িতে আমাদের পুরনো উত্তরবঙ্গের বাঁশ দিয়ে বানানো গোবর দিয়ে লেপা, মাচান করে ধানের গোলা একাধিক বাড়িতে দেখলাম। প্রচুর গাছপালা খড়ের পুঁজি, মুরগি, গরু পশুপালন তারা করেন। গ্রামবাসীরা প্রকৃতির উপাসক। এই গ্রামে দেখলাম নাগাদের ঐতিহ্যশালী মোরং। এই মোরং হলো নাগাদের একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান। সমাজের সকল অবিবাহিত পুরুষ সদস্যদের সামাজিক জীবনের কেন্দ্রস্থল। এখানে অল্পবয়স্ক ছেলেরা তাদের বড়দের কাছ থেকে সামাজিক অনুশীলন সামাজিক রীতি-নীতি বিশ্বাস সবকিছু শেখে। আধুনিক পরিভাষায় মোরংকে বলা যেতে পারে ইয়ুথ ডরমিটারি। আমরা যখন মোরং-এ গেলাম তখন দেখলাম অল্পবয়সী ছেলেরা কাঠ কুড়িয়ে আনছে, আমাদের গাইড এপ্রিল তাদের সাথে কথা বলে জানালেন আগুন জ্বালিয়ে বড়দের কাছ থেকে তারা আজ সন্ধ্যায় গ্রাম সুরক্ষার বিষয়ে শিখবে। এই গ্রাম ছাড়াও নাগাল্যান্ডের অন্যান্য গ্রামেও এরকম মোরং আছে, মোরং এখনো নাগাল্যান্ডের গ্রামীণ সমাজে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মোরং নাগাল্যান্ডের ঐতিহ্যের অঙ্গ। এই গ্রামেও অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে আমরা সারাটা সন্ধ্যা কাটিয়েছিলাম।
পরদিন সকালেই আমরা মন থেকে নাগাল্যান্ডের আরেকটি জেলা শহর মককচুঙ যাব। এই মককচুঙ নাগাল্যান্ডের ১৬টি জেলার অন্যতম একটি জেলা। আমরা জেলার সদরের একটি হোটেলের রাত্রিবাস করব। এপ্রিল মানে আমাদের গাইড ছেলেটি জানালেন এই জেলায় আও নাগারা হলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ। এদেরও সমৃদ্ধশালী ঐতিহ্যপূর্ণ সংস্কৃতি আছে। তবে বর্তমানে এই উপজাতির প্রায় একশ ভাগই খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছেন। শহরে ঢোকবার সময় বেশ কয়েকটি বড় এবং সুদৃশ্য চার্চ দেখলাম। আসন্ন বড়দিনের জন্য চারদিক আলোকমালায় সাজানো। আও নাগারা বছর জুড়ে কৃষির সঙ্গে জড়িত। নানা উৎসব পালন করে। আশপাশটা একটু বেরিয়ে নিলাম। শহরটা অনেকটা আমাদের পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং-এর মত। শুনলাম এই শহরটি নাকি নাগাল্যান্ডে ব্রিটিশ নির্মিত প্রথম শৈল শহর। সম্ভবত ইংরেজ সেনাবাসের জন্যই তৈরি হয়েছিল। মিশনারীদের কল্যাণে অনেক স্কুল কলেজ ও চার্চ আছে। ইংরেজরা দেশ ছেড়ে চলে গেছেন কবে, কিন্তু ইংরেজিয়ানার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে রেখে গেছেন, মানুষজনদের দেখে তাই মনে হল। তবে নাগাল্যান্ডে ঢুকে প্রতিটি হোটেলেই একটি জিনিস দেখেছি, হোটেলগুলি মহিলা পরিচালিত। বাজার হাট দোকানে মহিলারা রয়েছেন। তাদের মালিকানাতেই সব চলছে। মাতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা এখনো বেশ কায়েম আছে।
হোটেল ছেড়ে পরদিন সকাল সকাল বেরিয়ে পড়তে হল কোহিমার উদ্দেশে। চারপাশে অপূর্ব নৈসর্গ। তবে সড়ক পথ ততটা ভালো নয়, ড্রাইভার ছেলেটি ও আমাদের গাইড এপ্রিল মাঝে মাঝেই আক্ষেপ করছিল রাস্তা ভালো না হলে এত কষ্ট করে ট্যুরিস্টরা আর আসবেন না। বেশিরভাগ ট্যুরিস্ট নাকি এ সময়ে বিমান পথে কোহিমায় এসে হর্নবিল উৎসব দেখে চলে যান। নাগাল্যান্ডের অতুলনীয় সৌন্দর্য রাশি, বিভিন্ন জনজাতিদের সংস্কৃতি ঐতিহ্য তারা দেখেন না। অতীতে কোহিমা আঙ্গামী নাগাদের একটি গ্রাম ছিল। ১৮৭৮ সালে অতীতের এই গ্রামটি একটি শহরে পরিণত হয়, যখন ব্রিটিশরা আসাম প্রদেশের তৎকালীন নাগা হিলস জেলার সদর দপ্তর প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৬৩ সালে নাগাল্যান্ড রাজ্যের উদ্বোধনের পর কোহিমা রাজধানী হয়। কোহিমা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম স্থান। অতীতে কোহিমা কেওহিরা নামে একটি বড় গ্রাম হিসেবে পরিচিত ছিল। নাগা আঙ্গামী ভাষায় কেওহিরা একটি বন্য ফুল। আগামী নাগা ভাষা Kewhi-ra ইংরেজদের মুখে মুখে কোহিমায় পরিণত হয়েছে। ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই অঞ্চলকে সেনাবাহিনীর দ্বারা মুক্ত করেছিল। ১৯৪৪ সালের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অনেক স্মারক কোহিমায় রয়েছে।
হর্নবিল উৎসব হল উত্তর-পূর্ব ভারতের একটি প্রধান বার্ষিক উৎসব। নাগাল্যান্ডের উৎসবটি প্রতিবছর ১ থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত নাগা ঐতিহ্য প্রচারে অনুষ্ঠিত হয়, শহরের কেন্দ্র থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে কিসামা হেরিটেজ ভিলেজে হর্নবিল উৎসব হয়। কোহিমা শহরে ঢোকার মুখেই প্রচন্ড জ্যামে পড়তে হল, প্রায় এক ঘন্টা সেখানে থেকে আমাদের গন্তব্যস্থলের দিকে রওনা হতে হলো। নাগা ঐতিহ্য ও আধুনিকতায় সজ্জিত কোহিমা শহর। প্রকৃতি যেন সযত্নে সাজিয়েছে এই শহরকে। মনটা কেমন করে উঠলো, এখানেই আছে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ও আজাদ হিন্দ বাহিনীর সংগ্রামের ইতিহাস। কোহিমা শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে যেখানে হর্নবিল বিল উৎসব হয়, সেই কিসামা ভিলেজে একটি হোমস্টেতে আমাদের তিন দিন থাকবার ব্যবস্থা হয়েছে । হর্নবিল শুরু হয়েছে পয়লা ডিসেম্বর থেকে, উপরাষ্ট্রপতি এসে উদ্বোধন করে গেছেন। আমরা ৭ই ডিসেম্বর রাতে পৌছালাম। ৮, ৯, ১০ই ডিসেম্বর, এই তিন দিন প্রাণ ভরে একেবারে সমাপ্তি অনুষ্ঠান পর্যন্ত আমরা হর্নবিল উৎসব দেখব।
হর্নবিল বাংলায় যাকে বলে ধনেশ পাখি। এই ধনেশ পাখির নামে নাগাল্যান্ডের এই জাতীয় উৎসব। ধনেশ পাখি বা হর্ন বিলের স্থান নাগা জাতি জনসমূহের ও সংস্কৃতি এবং লোকসাহিত্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি নাগা জনজাতির কাছেই ধনেশ পাখি অত্যন্ত শুভ বলে মনে করা হয়। নাগাল্যান্ডের প্রায় সব জনজাতি এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। নিজ নিজ গোষ্ঠীর নৃত্য সংস্কৃতি পরিবেশন করেন। ঐতিহ্যশালী কিসামা গ্রামের ইন্দিরা গান্ধী স্টেডিয়ামে এই অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। এই উৎসব নাগাল্যান্ডের পর্যটন শিল্পকলা ও সংস্কৃতি বিভাগ দ্বারা আয়োজিত হয়। গত দুবছর অতিমারির কারণে এই অনুষ্ঠান সম্ভব হয়নি। এবারে অবস্থা স্বাভাবিক হওয়াতে মহাসমারোহে অনুষ্ঠান হচ্ছে। নাগাল্যান্ড সরকার ২০০০ সাল থেকে এই উৎসব পালন করে আসছেন। নাগারা তাদের ঐতিহ্য ও পরম্পরাকে বাঁচিয়ে রাখতে এই উৎসব পালন করেন। পরদিন সকাল ন'টাতেই আমরা উৎসব প্রাঙ্গনে পৌঁছলাম। আমাদেরকে স্বাগত জানিয়ে উৎসব কমিটির পক্ষ থেকে ব্যাজ স্মরণিকা দেওয়া হল। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তো বটেই এছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জার্মানি অস্ট্রেলিয়া থেকেও বহু অতিথি এসেছেন। এই উৎসবের পরিচয় দিতে গিয়ে বলা হয় Festival of Festivals।
'নাগা' শব্দটির উৎস নিয়ে নানা অভিমত আছে। ক্যাপ্টেন জেক টলারের অভিমত, নাগা শব্দটি এসেছে নগ্ন (হিন্দি 'নাঙ্গা') থেকে 'নাগা'। কেউ কেউ মনে করেন সংস্কৃত 'নাগ' শব্দ থেকে 'নাগা' এসেছে। কারো অভিমত মহাভারতে বর্ণিত নাগলোকই আধুনিক নাগাল্যান্ড। এখানে মহাভারতের নায়ক অর্জুন এসেছিলেন নাগরাজকন্যা উলুপীর সাথে বিবাহ হয়েছিল, তাদের পুত্র ইরাবান কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে পান্ডবদের পক্ষে যোগ দিয়েছিলেন। বিখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ ভেরিয়ার এলুইন মনে করেন, নাগা শব্দটি এসেছে নোক (NOK) থেকে, যার অর্থ অধিবাসী বা জনসমূহ। আবার ভিন্ন অভিমত আছে ঐতিহাসিকভাবে নাগারা বর্মীজদেরই পাশাপাশি দীর্ঘকাল অবস্থান করেছেন, এই সূত্রে কেউ কেউ মনে করেন নাগা শব্দটি এসেছে বর্মীজ 'নাকা' শব্দ থেকে। বর্মীজ ভাষায় না-র অর্থ কান, কা-র অর্থ ছিদ্র করা। অতীতে কান ছিদ্র করে নাগাদের মধ্যে অলংকার পরার রীতি ছিল, হয়তো 'নাকা' থেকে 'নাগা' সেই স্মৃতির অনুসারী। জাতিগত ও ভাষাগত দিক থেকে নাগাদ এর সাথে তিব্বতীয়-বর্মীদেরই সাদৃশ্য বেশি।
স্মরণিকার অনুষ্ঠানসূচি থেকে জানলাম এবারের হর্নবিল উৎসবে ১৮ টি নাগা জনজাতি অংশগ্রহণ করেছেন। Angami, Ao, Chakhesang, Chang, Khiamniungan, Konyak, Lotha, Phom, Pochury, Rengma, Sangtam, Sumi, Tikhir, Yimkhiun, Zeliang, Garo, Kachari, Kuki। প্রতিটি জনজাতির কালচারাল ট্রুপ তাদের নিজস্ব ঐতিহ্যশালী পোশাকে সজ্জিত হয়ে অনুষ্ঠান শুরু হবার আগে অনুষ্ঠান প্রাঙ্গনে দাঁড়িয়ে অতিথিদের অভ্যর্থনা করেন। উৎসব প্রাঙ্গণের প্রতিটি জনজাতির প্যাভেলিয়ান তাদের নিজস্ব মোরং-এর শৈলীতে সজ্জিত। ঐতিহ্যবাহী নাগা শাল, গয়না, শিরস্ত্রাণ, তাদের পরিচয়ের অংশ। কাচ, ফুল, পাথর, দাঁত, নখ, শিং, ধাতু, হাড়, কাঠ, বীজ, চুল, আঁশ, পুঁতি দিয়ে তৈরী গয়না। এইসব ঐতিহ্যবাহী পোশাক গয়না এই উৎসবের মেলা প্রাঙ্গনেও প্রচুর বিক্রি হতে দেখেছি। পোশাকে ও গয়নায় কালো সাদা রংই বেশি। অনেকের মাথায় চুলে টুপিতে ধনেশ পাখির ঠোঁটের মত কিছু বসানো। সাজসজ্জা করে বিভিন্ন নাগা জনজাতিরা নারী-পুরুষ সম্মিলিতভাবে তাদের নাচগান পরিবেশন করেন। নাচগানের সাথে পরম্পরাগত লোকক্রীড়া, মল্লযুদ্ধ, তীরন্দাজি এইসব ক্রীড়াও পরিবেশিত হয়। এমনকী হেড হান্টিং নৃত্য প্রদর্শিত হতে দেখেছি। এই উৎসবে হাতির দাঁতের অলংকার পরে নাচ গান করাও ঐতিহ্যের বিষয়বস্তু। ফসল বপন করা,ফসল কাটা, মাছ ধরা, পুরনো হেড হান্টিং ও রংমা নৃত্য এখানে দেখেছি। বিভিন্ন নাগা জাতির ঐতিহ্য, ইতিহাস, লোকাচার, গান-নাচ-খেলা-যুদ্ধ-রীতি সবকিছু দেখবার সুযোগ মেলে এই হর্নবিল উৎসবে। পোশাকে প্রতিটি গোষ্ঠীর নিজস্ব টোটেম চিত্রিত থাকে।
উৎসব প্রাঙ্গনে বিভিন্ন নাগা উপজাতিদের যে মোরং থাকে সেখানে তাদের খাবারদাবার পোশাক-আশাক গয়না ইত্যাদিও বিক্রি হয়। প্রতিটি প্যাভিলিয়ানেও নিজস্ব সংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সম্ভার সাজিয়ে রাখা হয়। প্রতিদিন সন্ধ্যায় রক মিউজিকের আসর বসতো। দেশি-বিদেশি যন্ত্র নিয়ে বহু ব্যান্ডের দল সেখানে উপস্থিত হত। নাগা ঐতিহ্যবাহী নৃত্যগীত খুবই বর্ণাঢ্য। যুদ্ধের নৃত্যগুলি পুরুষরাই প্রদর্শন করতেন। নারী-পুরুষের সম্মিলিত বহু অনুষ্ঠান থাকতো। বিভিন্ন কালচারাল ট্রুপ এর মধ্যে প্রতিযোগিতা চলে। লোকসংস্কৃতি, লোকক্রীড়া প্রতিযোগিতা ছাড়াও মিস নাগাল্যান্ড সুন্দরী প্রতিযোগিতা, বিভিন্ন ফ্যাশন শো, সংগীত-সাহিত্য-চলচ্চিত্র ইত্যাদিরও প্রদর্শনী ও প্রতিযোগিতা চলতো। হর্নবিল উৎসবের শেষ দিনও আমরা ছিলাম। এই সমাপ্তিসূচক অনুষ্ঠানটি সত্যি মনে রাখবার মতো। এই শেষের দিনের অনুষ্ঠানের সব সেরা প্রতিযোগীদের পুরস্কৃত করা হয়। শেষ হয় বনফায়ার দিয়ে। মাঠের মাঝখানে প্রচুর কাঠ স্তূপাকৃতি করা হয়। অনুষ্ঠান কমিটির কর্তা-ব্যক্তিরা প্রতিটি নাগা জনজাতির কালচারাল ট্রুপের সদস্যরা এমনকি মিস নাগাল্যান্ড সুন্দরী সকলেই হাত ধরাধরি করে মাঠের চারপাশে ওই অগ্নিকুণ্ডকে প্রদক্ষিণ করে নাচ করে, উৎসব শেষে পর্যটকরা বিদায় নেয়।
নাগাল্যান্ডের পর্যটন বিকাশে হর্নবিল উৎসব বহু বছর ধরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। আমরা উৎসবের এই তিন দিন মধ্যাহ্ন ভোজের জন্য যেতাম একটি বিশেষ প্যাভিলিয়নে, এক নাগা মহিলা পরিচালিত রেস্তোরাঁতে। এখানকার কর্মচারীরা সবাই উত্তরবঙ্গের অধিবাসী, ওদের কাছ থেকে জানলাম এই নাগা ভদ্রমহিলা আলিপুরদুয়ার জেলার কুমারগ্রামের বাসিন্দা, সেখানে তাদের অনেক জমি এবং হোটেল রয়েছে। ভদ্রমহিলা ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলাও বলতে পারেন। ভাত-ডাল-তরকারি নানা রকম নিরামিষ পদ, লুচি-পুরি-মিষ্টি-পায়েস সমস্ত কিছুই সেখানে পাওয়া যেত। ভদ্রমহিলা জানালেন এই হর্নবিল বিল উৎসবে আসা তার কাছে নেশার মতো, লাভ-লোকসানের তোয়াক্কা তিনি তেমন করেন না, কিন্তু তিনি এখানে আসেন প্রতি বছর। বহুদিন নাগাল্যান্ড থেকে ছেড়ে যাওয়া তার পরিবারের নানা স্মৃতির সন্ধানে।
হর্নবিল উৎসবের পরেও আমরা কোহিমাতে দুদিন ছিলাম। কোহিমায় দ্রষ্টব্য অনেক কিছু আছে। এর মধ্যে নাগাল্যান্ড স্টেট মিউজিয়াম উল্লেখ্য, যেখানে নাগাদের সমস্ত জনগোষ্ঠীর ইতিহাস শিল্পকর্ম রাখা আছে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতি সম্বলিত ওয়ার মিউজিয়াম। আমরা এই মিউজিয়ামে বেশ কয়েক ঘন্টা কাটিয়েছিলাম। ব্রিটিশ মিত্রপক্ষ ও জাপানিদের যুদ্ধ নেতাজির আজাদহিন্দ বাহিনীর বহু স্মৃতি এখানে যেন কথা বলে। আজাদ হিন্দ বাহিনী ও নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর বহু তথ্য এখানে রক্ষিত আছে। নাগাল্যান্ডের কীটপতঙ্গ পশুপাখি যা খাদ্যদ্রব্য হিসেবে গ্রহণ করা হয় সেই আকর্ষণীয় বাজারটিও ঘুরে এলাম। নাগাল্যান্ডের প্রধান খাদ্য ভাত, অধিকাংশ বাড়িতেই মসলাদার সস এবং মাংস রান্না হয় নিজস্ব রন্ধন প্রণালীতে। বাঁশের অংকুর, শুকনো মাছ, এছাড়াও নানা আঞ্চলিক উপাদান দিয়ে খাবার তৈরি হয়। শুয়োরের মাংস অনেকের খুব প্রিয় খাদ্য। কোহিমা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসের সাক্ষী। কোহিমার একটি গুরুত্বপূর্ণ দ্রষ্টব্যস্থল কোহিমায় নিহত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্র বাহিনীর সৈনিকদের সমাধিস্থল। এই সমাধিস্থলে ব্রিটিশ ও ভারতীয় সেনাদের যারা যুদ্ধে নিহত হয়েছেন তাদের প্রতিটি সমাধিস্থলে নাম বয়স ব্রোঞ্জের প্লেটে লেখা আছে তাদের পরিচয়। কোহিমা যুদ্ধে আজাদ হিন্দ ফৌজের মৃত সৈনিকদের যুদ্ধ স্মারকে লেখা আছে- When you go home, tell them of us and say, for their tomorrow we gave our today। বিষাদে মন ভরে যাচ্ছিল, ভাবছিলাম যুদ্ধের কেন অবসান হয় না আজো?
কোহিমার বেশিরভাগ মানুষই খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী, বহু বড় বড় ঐতিহ্যশালী চার্চ দেখেছিলাম। দেখতে দেখতে নাগাল্যান্ড ভ্রমণের মেয়াদ শেষ হয়ে এলো। এই ভ্রমণের শেষ পর্বে ছিল কোহিমা শহর থেকে কুড়ি কিলোমিটার দূরে খনোমা গ্রাম, একদিন একরাত্রি সেখানে থাকবার ব্যবস্থা। এই গ্রামটি প্রকৃতি সংরক্ষণ প্রচেষ্টার কারণে ভারতের প্রথম সবুজ গ্রাম হিসেবে পরিচিত। চারদিকে পাহাড় বেষ্টিত সবুজ শোভিত সুন্দর একটি গ্রাম। এই গ্রামে একটি শিকার প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে এক সপ্তাহে প্রায় ৩০০ জুন মানুষ বিপন্ন হয়েছিলেন। তারপর থেকে এখানে শিকার নিষিদ্ধ করা হয়। গ্রামের ভূখণ্ডটি পাহাড়ি মৃদু ঢাল থেকে খাড়া এবং এবড়োখেবড়ো। গ্রামটিতে বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণীসম্পদ রয়েছে। এই গ্রামে নাকি তিতির পাখির দেখা মেলে। ৪২৪টির মতো পরিবার এখানে বাস করে। গ্রামটিতে আঙ্গামী নাগারাই প্রধান। ১৮৩০ থেকে ১৮৮০ সাল পর্যন্ত খনোমার আঙ্গামী নাগারা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ভয়ংকর যুদ্ধে লিপ্ত হয়। পরে ব্রিটিশদের সাথে একটি শান্তি চুক্তি হয়। এক সময়ে এখানে দাসপ্রথা চালু ছিল। ব্রিটিশরা এখানে খ্রিস্টধর্ম প্রবর্তন করে, সময়ের সাথে সাথে বেশিরভাগ গ্রামবাসী খ্রিস্টান হয়ে যান। গ্রামের বেশিরভাগ মানুষরাই কৃষিজীবী; প্রায় কুড়িটি প্রজাতির ধান এখানে হয় শুনেছি। ব্রিটিশদের সাথে নাগাদের যুদ্ধের শহীদ স্মারক স্তম্ভ এখানে আছে। স্বাধীনতার আগে নাগা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী গ্রামের অধিবাসী শহীদদের স্মারকও এই গ্রামে রয়েছে। এই গ্রামের একটি প্রধান দ্রষ্টব্য খনোমা ফোর্ট, যেখানে আঙ্গামী যোদ্ধারা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। চারদিকে ঘন সবুজ শান্ত নিরিবিলি উদার প্রকৃতির নীড়ে একটা দিন খুব সুন্দর আমরা কাটালাম।
পরদিন থেকেই আমাদের ঘরে ফেরার শুরু। খনোমা থেকে আবার কোহিমা টুরিস্ট অফিসের দপ্তরে কাগজপত্র জমা দিয়ে, সেখান থেকেই আমাদের গাইড মিস্টার এপ্রিল বিদায় নেবেন। প্রাণবন্ত ছেলেটি খুবই মায়াময়, যাবার সময় আমাদেরকে জড়িয়ে ধরে বলল, আবার আসবেন। যে গাড়িটিতে শিমালগুড়ি থেকে আমরা এসেছিলাম সেই গাড়িটি নিয়েই আমরা নাগাল্যান্ডের সর্বত্র ঘুরেছি। ড্রাইভার ছেলেটি কোহিমা থেকে আমাদের ডিমাপুর পর্যন্ত নিয়ে যাবে। ডিমাপুর রেলস্টেশনে নামিয়ে দিয়ে সে গৌহাটি ফিরে যাবে। ডিমাপুর স্টেশনের রিটায়ারিং রুমে আমাদের থাকবার বন্দোবস্ত ছিল। মাঝরাতে গৌহাটি থেকে ট্রেনে উঠবো, সেখান থেকেই যে যার জায়গায় ফিরে যাব।
ডিমাপুর শহরটাও ড্রাইভার ছেলেটি একটু ঘুরিয়ে দেখালো। ডিমাপুর পর্বতসঙ্কুল নাগাল্যান্ডের একটি জেলা শহর, সমতলে অবস্থিত। ধানসিড়ি নদীর তীরে আসামের সীমান্তে অবস্থিত ডিমাপুর। এই ডিমাপুর নাগাল্যান্ডের অন্যতম প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র। ডিমাপুর রেলস্টেশন উত্তর-পূর্ব ভারতের দ্বিতীয় ব্যস্ততম স্টেশন। ১৩ শতাব্দীতে ডিমাপুর ডিমাসা রাজ্যের রাজধানী ছিল। শহরের কেন্দ্রস্থলে ডিমাসা কাছারি রাজ্যের পুরনো কিছু নিদর্শন রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ ভারতীয় ডিমাপুর ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ডিমাপুর নামের ইতিহাসটি বেশ আকর্ষক। ডিমাসা নাগাল্যান্ডের একটি উপভাষা। ডি অর্থ জল, মা অর্থ বড়, পুর অর্থ জনপদ। কেউ কেউ দাবি করেন ডিমাপুর হলো মহাভারতের ভীম পত্নী হিড়িম্বা র রাজ্য, হিড়িম্বাপুর। ডিমাপুর হলো এই হিড়িম্বা পুরের অপভ্রংশ। এই ডিমাসা কাছারি রাজ্য একসময় হেরম্ব রাজ্য নামেও পরিচিত ছিল। বহু বাঙালিও বসবাস করেন এই শহরে। স্টেশনে রেলকর্মী ও দোকানপাটের অনেকেই দেখলাম বাঙালি।
আসামের শিমালগুড়ি দিয়ে আমরা নাগাল্যান্ডে ঢুকেছিলাম, ডিমাপুরে এসে আমাদের সেই যাত্রা শেষ হল। মাঝরাতে গৌহাটিগামী ট্রেন এলো, আমরা সকাল-সকালই গৌহাটিতে পৌঁছে গেলাম। এবার ঘরে ফেরার পালা। কবীরের দোঁহা দিয়ে শুরু করেছিলাম। শেষ করব কবীরের ভজন দিয়ে- "যা হংস উড় যা একেলে"। ইউটিউবের দৌলতে পন্ডিত কুমার গন্ধর্ব-র স্বর্গীয় কন্ঠে যতবার শুনেছি মুগ্ধতা ও বিস্ময়ে জগতের সমস্ত দুঃখ ভার নামিয়ে দিয়ে দূরে কোথাও একা একা উড়ে যেতে ইচ্ছে করেছে। জীবনে গতি আনে পর্যটন, এক পর্যটন শেষ হয় আর এক পর্যটনের শুরু হয়। অপেক্ষায় থাকবো আবার আর এক আরম্ভের জন্য।